Home কৃষি ২০০ কোটি টাকার উন্নত চারা নিয়ে প্রস্তুত পাইকগাছা

২০০ কোটি টাকার উন্নত চারা নিয়ে প্রস্তুত পাইকগাছা

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি

পাইকগাছা: স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে উন্নত চারা নিয়ে প্রস্তুত পাইকগাছা উপজেলার এক হাজার ২০০ নার্সারি। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে চারা। এ বছর ২০০ কোটি টাকার চারা বিক্রি হতে পারে বলে নার্সারি মালিকরা আশা করছেন।
পাইকগাছা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ দফতর সূত্রে জানা যায়, পাইকগাছার গদাইপুর, কপিলমুনি ও হরিঢালী ইউনিয়নের প্রায় একশ’ হেক্টর জমিতে ছোট-বড় এক হাজার দুই শতাধিক নার্সারি গড়ে উঠেছে। সবচেয়ে বেশি নার্সারি রয়েছে গদাইপুর ইউনিয়নে। লাভজনক ব্যবসা হওয়ায় দিনদিন নার্সারির সংখ্যা বাড়ছে। চলতি বছর রাড়ুলী ও চাঁদখালী ইউনিয়নের বেশ কিছু মানুষ চারা উৎপাদন শুরু করেছেন। এসব নার্সারিতে ফলদ, বনজ, ওষধি ও ফুলের প্রায় দুই থেকে আড়াই শত প্রকারের চারা উৎপাদিত হয়।
এসব নার্সারিতে তৈরি চারা যশোর, বান্দরবন, ভোলা, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, রংপুর, সিলেট, বরিশাল, কুমিল্লা, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে। উৎপাদিত চারার মধ্যে বেদানা, কমলা, আমড়া, জামরুল মাল্টা, জাম্বুরা, সফেদা, বড়ই, কামরাঙ্গা, মিষ্টি তেঁতুল, চালতা, লিচু, কদবেল, লটকন, আঠাহীন কাঁঠাল, বারোমাসি কাঁঠাল, নারকেল, তেঁতুল, সুপারি, লিচু, থাই লঙ্গন, রুবি লঙ্গন, এবোকাডো, কাজু বাদাম, রক্ত চন্দন, শ্বেত চন্দন, হরিমন আপেল, পেঁপে, হাইব্রিড সজিনা, বকুল, জি নাইন কলা, আমলকি, তেজপাতা ও করোসল (ক্যান্সার প্রতিরোধক)সহ বিভিন্ন প্রজাতির দেশি-বিদেশি গাছের চারা। আমের জাতের মধ্যে রয়েছে বারি আম-৪, বারি আম-১১, ব্রুনাই কিং, ব্ল্যাক স্টোন, ব্যানানা ম্যাংগো, ফোর কেজি, রেড পাল্মার, সূর্য ডিম, কেউ যাই, ফজলি থাই কাটিমন, মিয়া জাকি, ইয়ান ফাইভ, হাড়িভাংগা, অম্রপালি, হিমসাগর, ল্যাংড়া প্রভৃতি।

পাইকগাছার নার্সারি মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা বীজ ও কলম দুই ধরনের চারা উৎপাদন করেন। তবে মাতৃগুণ বজায় রাখা, দ্রুত ফলন, রোগ প্রতিরোধে ক্ষমতা বাড়ানো এবং অধিক ফলন পেতে গাছের অঙ্গ ব্যবহার করে কলমের চারা বেশি উৎপাদন করেন। কলমের গাছে তাড়াতাড়ি ফল ধরে এবং গাছ ছোট হয় বিধায় অল্প জায়গায় অনেক গাছ লাগানো যায়। এ কলম বিভিন্ন পদ্ধতিতে করা হয়। যেমন- গুটি কলম, শাখা কলম (কাটিং), চোখ কলম বা বাডিং। তবে কলম তৈরিতে গুটি কলম, জোড় কলম ও কাটিং কলম উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি।
পেয়ারা, লেবু, জলপাইসহ বিভিন্ন গাছে গুটি কলম তৈরি করা হয়। জোড় কলম তৈরি করতে গাছের ডালের সঙ্গে গাছের ডাল জোড়া লাগিয়ে জোড় কলম তৈরি করা হয়। তেজপাতার সঙ্গে কাবাবচিনি, আম সঙ্গে আম, সফেদার সঙ্গে খিরখাজুর, আতা সঙ্গে দেশি আতা জোড় দিয়ে জোড় কলম তৈরি করা হয়। কাঁটা জাতীয় কুলসহ বিভিন্ন ফলের চারা চোখ বসিয়ে বাডিং কলম তৈরি করা হয় এবং ফুল জাতীয় গাছের ডাল কেটে সরাসরি মাটিতে পুঁতে কাটিং কলম তৈরি করা হয়। বর্ষা মৌসুমের শুরুতে চারা তৈরির জন্য নার্সারি মালিক ও কর্মচারীরা কলম তৈরি করেন। এ কাজ চলে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত।
তারা আরো জানান, আষাঢ় থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫টি ট্রাক ভর্তি চারা দেশের বিভিন্ন জেলাতে সরবরাহ হয়ে থাকে। এছাড়া এ বছর অনলাইনে প্রচুর চারা বিক্রি হচ্ছে।
গদাইপুর ইউনিয়নের গদাইপুর গ্রামের আফসার আলী গাজী জানান, প্রায় ৮ বিঘা জমিতে জোড় কলম তৈরির নার্সারি ব্যবসা গড়ে তুলেছেন। তিনি দেশ বিদেশ থেকে বীজ ও চারা সংগ্রহ করে নিজে মাতৃ বাগান তৈরি করেছেন। সঠিক জাত নির্বাচনের পর সেখান থেকে কলম তৈরি করে দেশের বিভিন্ন জেলায় চারা কলম সরবরাহ করে থাকেন। প্রায় ৩০ লাখ টাকার কলম চারা রয়েছে বিক্রি হয়েছে। এখনো বিক্রি হচ্ছে। নার্সারিতে ১৫ জন মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
গদাইপুরের নেহা নার্সারির মালিক রওশানারা জানান, তিন বিঘা জমিতে চারা উৎপাদন করেন। এ বছর এরইমধ্যে ৬০ থেকে ৭০ হাজার চারা বিক্রি করে ৪০ লক্ষাধিক টাকা পেয়েছেন। বেশি বিক্রি হয়েছে নারকেল ও খেজুরের চারা। এছাড়া আম, আমড়া, পেয়ারা, লেবুর কলমের চারাও প্রচুর বিক্রি হয়েছে।
হিতামপুর গ্রামের দীপঙ্কর অধিকারী জানান, দশ বছর আগে পিতা সুকুমার অধিকারীর মাধ্যমেই নার্সারি ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে তার পৈত্রিক ছয় বিঘা জমিতে নার্সারি ব্যবসা গড়ে তুলেছেন। তার নার্সারিতে ১০ জন মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এ বছর ভালো দাম পাচ্ছেন।
গদাইপুর নার্সারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কামাল সরদার বলেন, গেল বছর একশ ৮০ কোটি টাকার চারা বিক্রি হয়। চলতি মৌসুমে প্রায় ২০০ কোটি টাকার চারা বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে। পাইকগাছায় উৎপাদিত চারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি হচ্ছে। নার্সারি করে দেড় হাজারের বেশি পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে। চারা বিক্রিতে ভালো দাম পাচ্ছি। দেশের বিভিন্ন জেলায় চারা সরবরাহ করা হচ্ছে।
পাইকগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এখানে নার্সারি শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে। এবছর ২০০ কোটি টাকার চেয়ে বেশি চারা বিক্রি হবে বলে আশা করছি। এখানে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশি-বিদেশি উন্নত জাতের চারা উৎপাদন হচ্ছে। চারা উৎপাদনের মাধ্যমে তারা দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। নার্সারিগুলোতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা একদিকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে, অন্যদিকে তারা স্বাবলম্বী হচ্ছে। উন্নত পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন ও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষার পরামর্শ দেওয়াসহ সার্বক্ষণিক তাদের পাশে রয়েছে কৃষি দফতর।
কৃষি সম্প্রসারণ দফতর, খুলনার উপপরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, নার্সারি ব্যবসা একটি সম্ভাবনাময় খাত। বেকার যুবকদের আত্মকর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। এ ব্যবসার মাধ্যমে তারা নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি দেশের খাদ্য, পুষ্টি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন। কেউ এগিয়ে আসলে কৃষি দফতর তাদের সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন।