নয়ন দাস, কুড়িগ্রাম: বাংলাদেশে একসময় রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস ছিল পাট ও পাটজাত পণ্য। বৈদেশিক বাজারে কৃত্রিম তন্তুর বিস্তার ও অভ্যন্তরীণ শিল্পখাতের দুর্বলতার কারণে কয়েক দশক ধরে এই খাত পিছিয়ে পড়লেও সাম্প্রতিক সময়ে পরিবেশবান্ধব পণ্যের বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধির ফলে আবারও পাটভিত্তিক শিল্পে নতুন জাগরণ দেখা যাচ্ছে।
উৎপাদন অঞ্চল
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ২৫টি জেলায় বাণিজ্যিকভাবে পাট চাষ হয়ে থাকে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুরা, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, জামালপুর ও নরসিংদী জেলা। বিশেষ করে ফরিদপুর ও কুষ্টিয়াকে দেশের পাটের ভাণ্ডার বলা হয়, যেখানে প্রতিবছর লাখ লাখ টন পাট উৎপাদিত হয়।
স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দাম ভালো পাওয়ায় তারা আবার পাট চাষে ঝুঁকছেন। ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার কৃষক জহুরুল হক বলেন, “কয়েক বছর আগে পর্যন্ত লোকসানের আশঙ্কায় অনেকে পাটের জমি কমিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখন বাজারে চাহিদা বাড়ায় আমরা আবার বেশি করে পাট চাষ করছি।”
শিল্প ও রপ্তানি সম্ভাবনা
বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ৬০টির বেশি দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়। ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশি জুট ব্যাগ, দড়ি, কার্পেট ও ডেকোর সামগ্রীর চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রক্রিয়াজাত প্রযুক্তি উন্নত করা গেলে আগামী পাঁচ বছরে এ খাত থেকে অন্তত ২ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, “বিশ্ব এখন পরিবেশবান্ধব বিকল্প খুঁজছে। আমাদের পাট সেই বিকল্প হতে পারে। যদি মাননিয়ন্ত্রণ ও বৈচিত্র্য আনা যায়, তাহলে পাট আবারও সবুজ সোনা হয়ে উঠবে।”
চ্যালেঞ্জ
তবে শিল্প খাতের কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়ে গেছে—
- অনেক সরকারি পাটকল এখনো পুরনো যন্ত্রপাতির ওপর নির্ভরশীল
- গবেষণা ও নতুন উদ্ভাবনে বিনিয়োগের ঘাটতি
- কৃষক পর্যায়ে উন্নত মানের বীজ ও আধুনিক প্রযুক্তির অভাব
- আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজাইন ও প্যাকেজিংয়ে বৈচিত্র্যের ঘাটতি
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
পাটভিত্তিক শিল্প পুনরুজ্জীবিত করতে “জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি)”কে আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে। পাশাপাশি, রপ্তানিমুখী কারখানার জন্য বিশেষ প্রণোদনা, কর ছাড় ও প্রযুক্তি সহায়তার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ফরিদপুর-কুষ্টিয়া থেকে শুরু করে টাঙ্গাইল-জামালপুর পর্যন্ত বিস্তৃত পাট চাষাবাদকে কাজে লাগিয়ে আধুনিক শিল্প গড়ে তুলতে পারলে বাংলাদেশ আবারও বিশ্ববাজারে সবুজ সোনার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।