Home ইতিহাস ও ঐতিহ্য পালংকি থেকে কক্সবাজার- ইতিহাস ও পর্যটনের মেলবন্ধন

পালংকি থেকে কক্সবাজার- ইতিহাস ও পর্যটনের মেলবন্ধন

মাহবুব হাসান, কক্সবাজার: বিশ্বের দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক বালুময় সমুদ্র সৈকতের শহর কক্সবাজার। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত এই জেলাটি কেবল তার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জন্যই বিখ্যাত নয়, এর পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। প্রাচীন ‘পালংকি’ থেকে আজকের আধুনিক পর্যটন নগরী হয়ে ওঠার গল্পটি বেশ রোমাঞ্চকর। ১২০ কিলোমিটার বিস্তৃত সৈকত, সামুদ্রিক মৎস্য বন্দর এবং পাহাড়-সমুদ্রের মিতালি এই শহরকে দিয়েছে অনন্য মর্যাদা।

নামকরণের ইতিহাস: পানোয়া, পালংকি ও কক্সবাজার
কক্সবাজারের নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে নীল জলরাশি। তবে এককালে এই জনপদ পরিচিত ছিল ‘পানোয়া’ নামে, যার আক্ষরিক অর্থ ‘হলুদ ফুল’। এর আরও একটি প্রাচীন নাম ছিল ‘পালংকি’।

আধুনিক কক্সবাজার নামের উৎপত্তি হয় ব্রিটিশ শাসনামলে। এই নামের পেছনে জড়িয়ে আছে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স (মৃত্যু ১৭৯৯)-এর নাম। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন সামরিক কর্মকর্তা ও পালংকির মহাপরিচালক। ১৭৭৩ সালের দিকে আরাকান শরণার্থী এবং স্থানীয় রাখাইনদের মধ্যে দীর্ঘদিনের সংঘাত নিরসন ও শরণার্থীদের পুনর্বাসনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর এই অসামান্য অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা প্রথমে ‘কক্স সাহেবের বাজার’ এবং কালক্রমে ‘কক্সবাজার’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৮৫৪ সালে এখানে থানা এবং ১৮৬৯ সালে পৌরসভা গঠিত হয়।

মুঘল আমল ও ডুলাহাজারা
কক্সবাজারের ইতিহাসের সাথে মুঘল সম্রাট শাহ সুজার নামও জড়িয়ে আছে। ১৬১৬ সালে মুঘলরা এই অঞ্চল অধিগ্রহণের আগে এটি আরাকান রাজ্যের অংশ ছিল। সম্রাট শাহ সুজা আরাকান যাওয়ার পথে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ক্যাম্প স্থাপনের আদেশ দেন। কথিত আছে, তাঁর যাত্রাবহরের প্রায় এক হাজার পালকি চকরিয়ার যে স্থানে অবস্থান নিয়েছিল, তা আজ ‘ডুলাহাজারা’ নামে পরিচিত। ‘ডুলা’ অর্থ পালকি এবং ‘হাজারা’ অর্থ হাজার।

ভৌগোলিক অবস্থান ও পর্যটন আকর্ষণ
চট্টগ্রাম শহর থেকে ১৫২ কি.মি. দক্ষিণে এবং রাজধানী ঢাকা থেকে ৪১৪ কি.মি. দূরে অবস্থিত কক্সবাজার। পর্যটন শিল্পকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত অসংখ্য হোটেল, মোটেল এবং আন্তর্জাতিক মানের পাঁচতারা হোটেল।

পর্যটকদের কেনাকাটার জন্য সৈকতের কাছেই রয়েছে ঝিনুক মার্কেট। এছাড়া সীমান্তপথে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও চীন থেকে আসা বাহারি পণ্য নিয়ে গড়ে উঠেছে বিখ্যাত ‘বার্মিজ মার্কেট’। এখানকার অন্যতম আকর্ষণ হলো শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া বাঁকখালী নদী, যা মৎস্য শিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ধর্মীয় ঐতিহ্য
কক্সবাজার কেবল বাঙালির নয়, বরং বহু নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মিলনমেলা। এখানে চাকমা সম্প্রদায়সহ বিভিন্ন উপজাতি বাস করে, যা শহরটিকে সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য কক্সবাজার একটি পবিত্র তীর্থস্থান। কক্সবাজার শহর এবং এর অদূরে রামুতে রয়েছে অসংখ্য বৌদ্ধ মন্দির ও ক্যাং। শহরের মন্দিরটিতে সংরক্ষিত আছে বেশ কিছু দুর্লভ বৌদ্ধ মূর্তি, যা পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

প্রকৃতি, ইতিহাস এবং সংস্কৃতির এক অপূর্ব সংমিশ্রণ কক্সবাজার। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর স্থান হিসেবে স্বীকৃত। সাগরের গর্জন, প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষী এবং আধুনিক পর্যটন সুবিধার সমন্বয়ে কক্সবাজার আজ বাংলাদেশের পর্যটন রাজধানী হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।