সম্পাদকীয়
বাংলাদেশের পর্যটন খাতে গত এক দশকে যে উল্লম্ফন দেখা গেছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির মধ্যে যে একটি বেপরোয়া, দায়িত্বহীন ও নিয়ন্ত্রণহীন প্রবাহ তৈরি হয়েছে, তা এখন প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। বান্দরবানের আলীকদমে স্মৃতি আকতার ও শেখ জুবাইরুল ইসলামের মৃত্যু এবং সহ-আয়োজক হাসানের নিখোঁজ হওয়া—এ শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং এটি আমাদের পুরো পর্যটন ব্যবস্থার নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।
১১ জুন, অনলাইনভিত্তিক ট্র্যাভেল গ্রুপ ‘ট্যুর এক্সপার্ট’ ৩৩ জন পর্যটককে নিয়ে যে পাহাড়ি অভিযানে যায়, সেটি ছিল আবহাওয়ার বিপদসঙ্কুল বার্তা উপেক্ষা করে গঠিত। অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া বর্ষা ইসলাম বৃষ্টিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, এবং তার বিরুদ্ধে দায়িত্বহীনতার অভিযোগ উঠেছে। প্রশ্ন হচ্ছে—সত্যিকার অর্থে এই দায় শুধু কি একজন অ্যাডমিনের?
নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কী করছিল?
বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে পর্যটনের জন্য সরকারি অনুমতির বিধান থাকলেও বাস্তবে তা মানা হয় না। স্থানীয় প্রশাসন, পর্যটন কর্পোরেশন ও বনবিভাগ কেউই এ নিয়ে সমন্বিত নজরদারি চালায় না। কোনো ট্র্যাভেল গ্রুপ দুর্গম এলাকায় যাচ্ছে কি না, কতজন যাচ্ছে, গাইড আছে কি না, তারা ফিরে এসেছে কি না, এই বিষয়গুলো দেখার কেউ নেই।
আমরা কি এমন পর্যটন চাই, যেখানে শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি তুলে তালি পাওয়া যায়, অথচ নিরাপত্তার ন্যূনতম মানটুকু মানা হয় না?
ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম-ভিত্তিক ট্র্যাভেল উদ্যোক্তাদের অনেকেই অদক্ষ, অপ্রশিক্ষিত ও ব্যবসাকেন্দ্রিক। তাদের বেশির ভাগেরই নেই কোনো পর্যটন শিক্ষা, নেই জরুরি স্বাস্থ্য বা উদ্ধারব্যবস্থার জ্ঞান। তাদের মূল উদ্দেশ্য—কম খরচে বেশি মানুষকে নিয়ে গিয়ে লাভ করা। আর এর ফলেই বারবার ঘটছে প্রাণহানির মতো মর্মান্তিক ঘটনা।
রাষ্ট্র কী করবে?
- সরকারি পর্যটন নীতিমালা থাকলেও তা বাস্তবায়নে নেই জোরালো উদ্যোগ। এখন সময় হয়েছে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ ও নিবন্ধন ব্যবস্থার।
- প্রতিটি ট্র্যাভেল গ্রুপকে পর্যটন বোর্ডে নিবন্ধন করতে হবে।
- দুর্গম এলাকায় অভিযানের আগে আবশ্যিক অনুমতি ও আবহাওয়ার ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক করতে হবে।
- ভ্রমণ গাইড, রেসকিউ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহায়ক এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সংযোগ থাকা ছাড়া কোনো অভিযানে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া যাবে না।
পর্যটন শিল্প বাঁচাতে হলে ‘ভ্রমণ’কে পণ্য নয়, একটি পেশাদার সেবা হিসেবে দেখার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।
একটি ভ্রমণ, একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি, একটি পাহাড়ি অভিযানের পেছনে যদি লাশ পড়ে থাকে—তাহলে সেটি আর আনন্দ নয়, সেটি রাষ্ট্র ও সমাজের ব্যর্থতার একটি শোকগাথা।
আমরা এই ব্যর্থতা আর চাই না।