মন্তব্য প্রতিবেদন
বাংলাদেশের তরুণদের মাঝে পাহাড় ও অভিযাত্রা-ভ্রমণের প্রতি ভালোবাসা বেড়েছে কয়েকগুণ। কৃত্রিমতার ক্লান্তি আর নাগরিক ব্যস্ততা থেকে পালাতে তারা ঝুঁকে পড়ছে পাহাড়, ঝরনা, গহীন অরণ্যের দিকে। এই ভালোবাসা থেকে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ট্র্যাভেল গ্রুপ, যাদের অনেকেই অনলাইনভিত্তিক এবং ব্যবসায়িক।
কিন্তু বান্দরবানের আলীকদমে স্মৃতি আকতার ও জুবাইরুল ইসলামের মৃত্যু এবং ট্রিপের সহ-আয়োজক হাসানের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় এই ভালোবাসার পেছনে লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ শিথিলতা ও গাফিলতি, যা অব্যবস্থাপনা আর দায়িত্বহীনতার চোরাবালিতে পর্যটনকে ডুবিয়ে দিতে পারে।
আনন্দ থেকে বিভীষিকা
একটি দল পাহাড়ে অভিযানে যাবে এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে আয়োজিত অভিযানে যদি না থাকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস বিশ্লেষণ, নিরাপত্তা পরিকল্পনা, রুট অনুমতি, জরুরি উদ্ধারব্যবস্থা ও প্রশিক্ষিত গাইড তবে তা আর বিনোদন নয়, তা আত্মঘাতী বাণিজ্য।
এই ক্ষেত্রে ট্যুর এক্সপার্ট নামের অনলাইনভিত্তিক গ্রুপটি কী কী প্রস্তুতি নিয়েছিল, তার অনেক প্রশ্নের এখনো উত্তর মেলেনি। তবে বর্ষা ইসলাম বৃষ্টির গ্রেপ্তার এবং মৃত পর্যটকের পরিবারের অভিযোগ বলছে এই ট্রিপের মূল পরিকল্পনায়ই ছিল মারাত্মক ঝুঁকি।
অনুমতি ছাড়াই পাহাড়ে ট্রিপ?
যদি সত্যি হয়, বর্ষা ও তার দল কোনো প্রশাসনিক অনুমতি না নিয়েই দুর্গম পাহাড়ে পর্যটক নিয়ে যান, তবে এটি শুধু দায়িত্বহীনতা নয়, অপরাধ। পাহাড়ের আবহাওয়া অনিশ্চিত ও দ্রুত পরিবর্তনশীল। যে কোনো মুহূর্তে পাহাড়ি স্রোত কিংবা ভূমিধসে মৃত্যু হতে পারে। সেজন্যই স্থানীয় প্রশাসন, বনবিভাগ ও পর্যটন কর্পোরেশনের অনুমতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু অনেক ট্র্যাভেল গ্রুপ এটিকে একটি ‘ফর্মালিটি’ মনে করে এড়িয়ে যায়।
অনলাইনে জনপ্রিয়তা, বাস্তবে প্রস্তুতির অভাব
ফেসবুকে সুন্দর ডিজাইন করা পোস্ট, ছেলেমেয়েদের অ্যাডভেঞ্চারপ্রীতি আর সুন্দর ছবির লোভ দেখিয়ে অনেকেই গ্রুপ পরিচালনা করছেন। তাদের অনেকেই পাহাড়ে অভিযানের প্রকৃত বাস্তবতা বোঝেন না বা বোঝেন না ভান করে যান। অথচ, একটি ভুল সিদ্ধান্ত একটি পরিবারে শোক বইয়ে দেয়।
এটাই কি পর্যটনের ভবিষ্যৎ?
আধুনিক পর্যটনে নিরাপত্তা, দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারিত্ব এখন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। পর্যটনকে শুধুমাত্র ‘টাকা রোজগারের সুযোগ’ হিসেবে দেখলে আমরা আরও অনেক স্মৃতির প্রাণ হারাতে দেখব।
পর্যটন বোর্ড, স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত এইসব গ্রুপের কার্যক্রম নিবন্ধন ও নিয়মের মধ্যে আনা। একই সঙ্গে ট্র্যাভেল উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ ও সনদ বাধ্যতামূলক করা দরকার। পাহাড়ে অভিযান করতে চাইলে গাইড লাইসেন্স, আবহাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ, ফার্স্ট এইড জ্ঞান, স্থানীয় সংযোগ সব কিছুর প্রয়োজন আছে।
শেষ কথা
স্মৃতি ও জুবাইরের মৃত্যুর দায় শুধু স্রোতের নয়, দায় এই সমাজেরও যেখানে বিনোদনকে গায়ে পড়ে বিপজ্জনক করে তোলা হয়, অথচ তার জবাবদিহি কেউ করে না।
তাই এখনই সময় ট্র্যাভেল প্রেমকে অবহেলার হাত থেকে ফিরিয়ে আনা না হলে পাহাড় আমাদের আরও কাঁদাবে।