আন্তর্জাতিক ডেস্ক: পাকিস্তানে বন্যাদুর্গতদের সহায়তা কীভাবে দেওয়া হবে—এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া মতপার্থক্য এখন পরিণত হয়েছে ক্ষমতাসীন জোটের দুই প্রধান দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)-র মধ্যে পূর্ণমাত্রার রাজনৈতিক সংঘাতে।
আইনমন্ত্রী আজম নাজির তারার ৩০ সেপ্টেম্বর বিষয়টিকে ‘ঘরের ভেতরের ব্যাপার’ (ghar ka mamla) হিসেবে বর্ণনা করলেও, পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে প্রতিদিন দুই দলের নেতারা সংবাদ সম্মেলনে একে অপরকে তীব্র আক্রমণ করছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারিও মাঠে নেমেছেন।
বন্যা ত্রাণ বিতর্ক থেকেই সূত্রপাত
গত মাসে বন্যাদুর্গতদের সহায়তা প্রদানের বিষয়ে দুই দলের অবস্থান ভিন্ন হয়ে পড়ে। পিপিপি চেয়েছিল বেনজির ইনকাম সাপোর্ট প্রোগ্রাম (বিআইএসপি)-এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দিতে। অন্যদিকে পিএমএল-এন নেতৃত্বাধীন পাঞ্জাব সরকার জানায়, তারা নিজেদের সম্পদ ব্যবহার করেই ত্রাণ কার্যক্রম চালাবে।
বিআইএসপি পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি, যা দরিদ্র ও অসহায় পরিবারের বিশেষ করে নারীদের নগদ সহায়তা প্রদান করে।
এ সময় পিএমএল-এন নেতা রানা সানাউল্লাহ দাবি করেন, বিআইএসপি কার্যকর নয়—এটি হয় পুরোপুরি সংস্কার করতে হবে, না হয় বন্ধ করতে হবে। তার এই বক্তব্যের পাল্টা জবাবে পিপিপি নেতা হুমায়ুন খান বলেন, “এটা রাজনৈতিক লাভের সময় নয়, ঐক্য ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সময়।”
পাঞ্জাবের তথ্যমন্ত্রী আজমা বুখারি পাল্টা মন্তব্য করে বলেন, “যারা সিন্ধুকে প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষে পরিণত করেছে, তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন নেই।”
পরে পিপিপি নেত্রী আসিফা ভুট্টো-জারদারি বলেন, বিআইএসপি-ই ত্রাণ বিতরণের সবচেয়ে কার্যকর উপায়, এটি ব্যবহার না করা “অদূরদর্শিতা” হবে।
২৫ সেপ্টেম্বর পিপিপি চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারি ঘোষণা করেন, “বিআইএসপি-ই একমাত্র উপযুক্ত মাধ্যম”। তার জবাবে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ও পিএমএল-এন নেতা মরিয়ম নওয়াজ অভিযোগ করেন, “পিপিপি বন্যাকে রাজনীতিকরণ করছে।”
মরিয়ম বলেন, “আমরা যদি সিন্ধুর দুর্যোগে পাশে দাঁড়াই, তাহলে পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে কেন তারা বাধা দেবে?” তিনি আরও মন্তব্য করেন, “মাত্র ১০ হাজার রুপি দিয়ে যারা ঘরবাড়ি ও ফসল হারিয়েছে, তাদের কষ্ট লাঘব সম্ভব নয়।”
‘আমার পানি, আমার টাকা’ — চোলিস্তান খালের ইস্যুতে উত্তেজনা
২৯ সেপ্টেম্বর মরিয়ম নওয়াজ পুনরায় চোলিস্তান খাল প্রকল্পের বিষয়টি উত্থাপন করেন, যা দীর্ঘদিন ধরে সিন্ধু ও পাঞ্জাব সরকারের মধ্যে বিতর্কের কেন্দ্র। সিন্ধু প্রদেশের দাবি, এই প্রকল্পে তাদের পানির প্রাপ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
মরিয়ম বলেন, “যদি পাঞ্জাব নিজের পানির জন্য খাল নির্মাণ করতে চায়, কেন আপত্তি? এটা আমাদের পানি, আমাদের কৃষকের অধিকার।” তিনি আরও যোগ করেন, “ভারতও তাদের পানি ব্যবস্থাপনায় এমন করেছে, তাহলে আমি কেন পারব না? এটা আমার পানি, আমার টাকা, আমার অধিকার।”
পিপিপির প্রস্তাব অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সহায়তা নেওয়ার প্রস্তাবও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন—“আপনাদের পরামর্শ নিজের কাছে রাখুন। পাঞ্জাব আপনার বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না, তাই আপনারাও করবেন না।”
সংসদে পিপিপির বিক্ষোভ ও বয়কট
পরের দিন (৩০ সেপ্টেম্বর) জাতীয় সংসদে পিপিপি নেতা নবিদ কামার মরিয়মের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে দলীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ে ওয়াকআউট করেন। তিনি বলেন, “নদীর পানি সবার, এটি কারও একার সম্পত্তি নয়।”
তিনি অভিযোগ করেন, “আমরা জাতীয় স্বার্থে সরকারের সঙ্গে আছি, কিন্তু এমন ভাষায় আঘাত পাওয়া মেনে নেওয়া যায় না।”
এরপর আইনমন্ত্রী আজম নাজির তারার সংসদে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেন, “এটি জোটের অভ্যন্তরীণ বিষয়, শিগগিরই সমাধান হবে।” ১ অক্টোবর ইসলামাবাদে দুই দলের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকেও পিপিপি মরিয়মকে তার বক্তব্যে সংযমী হওয়ার পরামর্শ দেয়।
মরিয়মের দৃঢ় অবস্থান
৩ অক্টোবর মরিয়ম বলেন, “আমি কোনো অবস্থাতেই ক্ষমা চাইব না। আমি পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী—আমার জনগণের পক্ষ না নিলে কে নেবে?”
এই সময় প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ তার বড় ভাই নওয়াজ শরিফের সঙ্গে বৈঠক করে বিষয়টি প্রশমনের উদ্যোগ নেন। উপ-প্রধানমন্ত্রী ইশাক দারও সংসদে বলেন, “দুই দলের মধ্যে মতপার্থক্য দ্রুত সমাধান হবে।”
প্রেসিডেন্ট জারদারির হস্তক্ষেপ
৬ অক্টোবর সংসদের উভয় কক্ষেই পিপিপির ওয়াকআউটের কারণে কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। সিনেটে শেরি রহমান বলেন, “পাঞ্জাব থেকে সিন্ধুর বিরুদ্ধে উসকানিমূলক ভাষা জোটের ঐক্য ক্ষুণ্ন করছে।”
এরপর প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নাকভিকে জরুরি বৈঠকের জন্য করাচিতে ডেকে পাঠান। প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে জানানো হয়, তিনি দুই প্রদেশের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনের উপায় নিয়ে আলোচনা করবেন।
সংঘাত অব্যাহত, মীমাংসা অনিশ্চিত
৭ অক্টোবরের পর পরিস্থিতি কিছুটা নরম হলেও, দুই দলের মধ্যে অবিশ্বাস রয়ে গেছে। শেরি রহমান সতর্ক করে বলেন, “সিনেটে আমাদের সমর্থন ছাড়া সরকার টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।”
অন্যদিকে মরিয়ম বলেন, “যারা পাঞ্জাবের উন্নয়ন দেখে ঈর্ষান্বিত, তাদের মানসিকতা পরিষ্কার করছি।”
অভ্যন্তরীণ সূত্রের বরাতে জানা গেছে, পিপিপির ক্ষোভ শুধু বন্যা ত্রাণ বা খাল প্রকল্প নয়, আরও অনেক নীতিগত বিষয়ে গভীর হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাকভির মাধ্যমে উচ্চপর্যায়ের মধ্যস্থতার উদ্যোগ চলছে, তবে এখনো জোটে স্থায়ী সমঝোতার লক্ষণ দেখা যায়নি।