- পিলখানা হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত,
- জড়িত বহিঃশক্তি ও আ. লীগ
- ‘তাপসের সমন্বয়, হাসিনার গ্রিন সিগন্যাল’
১৬ বছর পর প্রকাশ্যে এলো দেশের ইতিহাসে বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের মূল সত্য, প্রশ্নের মুখে তৎকালীন সরকার ও সেনা নেতৃত্ব
বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: বহুল আলোচিত, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ষোলো বছর পর এই নৃশংস ঘটনা নিয়ে গঠিত ‘জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন’ তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। রোববার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। প্রতিবেদনে এই হত্যাকাণ্ডকে সুপরিকল্পিত ঘোষণা করে এর সঙ্গে বহিঃশক্তি, তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্বের সরাসরি সম্পৃক্ততার শক্তিশালী প্রমাণ মিলেছে।
কমিশনের এই বিস্ফোরক রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর দেশের রাজনীতি ও সামরিক মহলে নতুন করে তোলপাড় শুরু হয়েছে।
ষড়যন্ত্রের মূলে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ ও সমন্বয়
প্রতিবেদন দাখিলের পর কমিশনের সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার ঘটনার মূল ফাইন্ডিংস সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। তাঁর বক্তব্যে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে:
পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড: জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার নিশ্চিত করেন, কমিশন প্রমাণ পেয়েছে যে এ হত্যাকাণ্ড ছিল সুপরিকল্পিত।
বহিঃশক্তির সরাসরি সম্পৃক্ততা: তদন্তে বিডিআর হত্যাকাণ্ডে বহিঃশক্তির সরাসরি সম্পৃক্ততা মিলেছে।
ক্ষমতাসীন দলের সংশ্লিষ্টতা: তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সরাসরি জড়িত থাকার শক্তিশালী প্রমাণ পাওয়া গেছে।
প্রধান সমন্বয়ক: হত্যাকাণ্ডের পেছনে প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন তৎকালীন সংসদ সদস্য এবং পরবর্তীকালে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস।
সরকারপ্রধানের সম্মতি: পুরো ঘটনাটি সংঘটিত করার ক্ষেত্রে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ (সবুজ সংকেত) ছিল।
অভিযুক্তদের রক্ষায় আ. লীগের মিছিল!
কমিশনের রিপোর্টে অভিযুক্তদের রক্ষার ক্ষেত্রে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ভূমিকার বিষয়টি বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ সরাসরি ভূমিকা রেখেছে। তারা ২০-২৫ জনের একটি মিছিল নিয়ে পিলখানায় ঢুকেছিল। কিন্তু বের হওয়ার সময় সেই মিছিলে দুই শতাধিক মানুষ ছিল। এর মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করা হয়।
সেনাপ্রধানসহ উচ্চপর্যায়ের দায়
প্রতিবেদনে এই ভয়াবহ ঘটনার দায়ভার নিরূপণ করতে গিয়ে তৎকালীন সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে সেনাপ্রধান পর্যন্ত সকলের দায় চিহ্নিত করা হয়েছে।
সেনাপ্রধানের রহস্যময় ভূমিকা: এ ঘটনায় তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদেরও দায় নিরূপণ করা হয়েছে। কমিশন প্রশ্ন তুলেছে, “কেন সেনাবাহিনী দাঁড়িয়ে থাকল, অ্যাকশন নিল না, সেটিও রহস্যময়।”
রাজনৈতিক সমাধান: এ ঘটনাকে সামরিক বা আইনগত প্রক্রিয়ায় না গিয়ে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
গোয়েন্দা ব্যর্থতা: পুলিশ, র্যাব এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর চরম ব্যর্থতা ছিল। এমনকি ঘটনার সময় কিছু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং কয়েকজন সাংবাদিকের ভূমিকা ছিল অপেশাদার।
তথ্য গোপন: হত্যাকাণ্ডের সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যেসব বিডিআর সদস্যের সঙ্গে শেখ হাসিনা বৈঠক করেছিলেন, তাদের সঠিক নাম-পরিচয় ও তথ্য সংরক্ষণ করা হয়নি।
আলামত ধ্বংস, বিদেশে পলায়ন: কমিশনের চ্যালেঞ্জ
প্রতিবেদন দাখিলের পর কমিশনপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান জানান, বহু আলামত ধ্বংস হয়ে গেছে এবং ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকে বিদেশে চলে গেছেন। তবে সর্বোচ্চ পেশাদারি বজায় রেখে সাক্ষীদের কাছ থেকে দীর্ঘ ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত বক্তব্য শোনা হয়েছে এবং পূর্ববর্তী তদন্ত রিপোর্টসহ অন্যান্য আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে।
প্রতিবেদন গ্রহণ করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে সমগ্র জাতি দীর্ঘদিন অন্ধকারে ছিল। এই কাজের মধ্য দিয়ে সেইসব প্রশ্নের অবসান ঘটবে। তিনি এই রিপোর্টকে জাতির জন্য এক ‘মূল্যবান সম্পদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর সরকার এই জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে। ভবিষ্যতে বাহিনীগুলোয় এ ধরনের ঘটনা এড়ানো এবং ভিকটিমরা যাতে ন্যায়বিচার পান, সেজন্য কমিশন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে।










