‘মজুতদারদের কারসাজি’ বনাম ‘কৃষকের স্বার্থ’
বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: মজুতদারদের অতি মুনাফার লোভ এবং কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার দোটানায় অস্থির হয়ে উঠেছে দেশের পেঁয়াজের বাজার। ‘পর্যাপ্ত মজুত আছে’ সরকারের এমন আশ্বাসের সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী যখন কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছিল, ঠিক তখনই কঠোর অবস্থানে গেল সরকার। সিন্ডিকেটের কারসাজি ভাঙতে এবং বাজার সহনীয় রাখতে রোববার (৭ ডিসেম্বর) থেকে সীমিত আকারে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি (আইপি) দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তবে এই সিদ্ধান্তে রয়েছে ভিন্ন কৌশল। ঢালাওভাবে আমদানির সুযোগ না দিয়ে ‘নিয়ন্ত্রিত উপায়ে’ আমদানির অনুমতি দেওয়া হচ্ছে, যাতে দেশি নতুন পেঁয়াজ বাজারে এলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত না হন।
হঠাৎ কেন আমদানির সিদ্ধান্ত?
মাত্র এক সপ্তাহ আগেও সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, দেশে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে এবং কৃষকের স্বার্থে এখনই আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে না। কিন্তু এই ঘোষণার পরপরই উল্টো চিত্র দেখা যায় বাজারে। অসাধু মজুতদাররা ‘আমদানি হবে না’—এই খবরটিকে পুঁজি করে গত চার-পাঁচ দিনের ব্যবধানে কেজিতে দাম বাড়িয়ে দেয় ১০ থেকে ১৫ টাকা।
রাজধানীর খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত সপ্তাহে যে পেঁয়াজ ১০৫-১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল, বুধবার তা বিক্রি হয়েছে ১১৫-১২০ টাকায়। সরকারের নমনীয় অবস্থানের সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিলে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয় আমদানির পথে হাঁটল।
আমদানির শর্তে সরকারের ‘কৌশল’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য অফিসার মোহাম্মদ জাকির হোসেনের পাঠানো বিজ্ঞপ্তি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সরকার এবার আমদানির ক্ষেত্রে বেশ সতর্ক। ঢালাওভাবে বাজার ভাসিয়ে না দিয়ে প্রতিদিন মাত্র ৫০টি করে ইমপোর্ট পারমিট (আইপি) ইস্যু করা হবে। প্রতিটি আইপিতে সর্বোচ্চ ৩০ টন পেঁয়াজ আনা যাবে। অর্থাৎ দৈনিক সর্বোচ্চ দেড় হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি মিলবে।
এখানেও রয়েছে কড়াকড়ি। নতুন কেউ চাইলেই আমদানি করতে পারবেন না। চলতি বছরের ১ আগস্ট থেকে যারা আবেদন করে রেখেছেন, কেবল তারাই সুযোগ পাবেন। একজন আমদানিকারক মাত্র একবারই এই সুযোগ পাবেন। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের এই ‘সীমিত পরিসর’ কৌশলের মূল লক্ষ্য হলো—বাজারে আমদানির ভীতি তৈরি করে মজুতদারদের গুদাম থেকে পেঁয়াজ বের করা, কিন্তু একইসাথে এত বেশি পেঁয়াজ না আনা যাতে আসন্ন মুড়িকাটা পেঁয়াজের দাম পড়ে যায়।
কৃষকের স্বার্থ বনাম ভোক্তার পকেট
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন এর আগে জানিয়েছিলেন, সরকারের কাছে আমদানির প্রায় ২ হাজার ৮০০ আবেদন জমা পড়ে আছে। এর ১০ শতাংশ অনুমোদন দিলেও বাজার সয়লাব হয়ে যাবে। তখন নতুন পেঁয়াজ নিয়ে বিপাকে পড়বেন কৃষকরা। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে পুরোদমে নতুন পেঁয়াজ বা মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে ওঠার কথা।
বর্তমানে বাজারে পাতাযুক্ত পেঁয়াজ ৭০-৮০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু মূল পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তাদের নাভিশ্বাস চরমে। টিসিবির হিসাবে গত বছরের তুলনায় দাম ১০ শতাংশ কম থাকলেও, বর্তমান বাজার দর (১২০ টাকা) সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
বাজারের ভবিষ্যৎ কী?
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানির খবরেই পাইকারি বাজারে দাম কিছুটা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে আমদানিকৃত পেঁয়াজ দেশে পৌঁছাতে এবং বাজারে সরবরাহ শুরু হতে আরও কয়েকদিন সময় লাগবে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, রোববার থেকে সীমিত আমদানির এই সিদ্ধান্ত মূলত একটি ‘চাপ প্রয়োগকারী কৌশল’। সরকার মজুতদারদের বার্তা দিতে চাইছে যে, দাম না কমালে প্রয়োজনে আরও বড় পরিসরে আমদানির দরজা খুলে দেওয়া হবে। এখন দেখার বিষয়, এই কৌশলী পদক্ষেপে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কমে সাধারণ মানুষের পাতে স্বস্তির পেঁয়াজ জোটে কি না।










