বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, কলকাতা: ভারত সরকার হঠাৎ করে বাংলাদেশ থেকে স্থলপথে পণ্য আমদানি বন্ধ করায় পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকায় দেখা দিয়েছে অভাব-অনটনের করুণ চিত্র। মে মাস থেকে পেট্রাপোল, হিলি, চ্যাংড়াবাধা, মহদিপুর এবং ফুলবাড়ি সীমান্ত দিয়ে সমস্ত রকম পণ্য লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের হাজার হাজার শ্রমিক, পরিবহনকর্মী এবং ছোট ব্যবসায়ী।
এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশ থেকে ভারতের বাজারে পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্যসহ বিভিন্ন পণ্য প্রবেশ বন্ধ হয়ে গেছে। স্থলপথের পরিবর্তে এখন সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে কিছু সীমিত বাণিজ্য চালু থাকলেও, পরিবহন ব্যয় ও সময় বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা পড়েছেন চরম ক্ষতির মুখে।
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর পেট্রাপোল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ ট্রাক পণ্য যেত ভারতে। এখন সেই সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র সপ্তাহে এক-দু’দিনে ১০০ ট্রাকের নিচে। সীমান্ত শহরগুলো হয়ে উঠেছে নিঃসঙ্গ ও কর্মহীন। দোকানপাট বন্ধ, শ্রমিকেরা কাজহীন, পরিবহনকর্মীদের গাড়ি থেমে আছে গ্যারেজে।
পেট্রাপোল বন্দরের ক্লিয়ারিং এজেন্টদের সংগঠনের সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী জানান, “ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশে যাওয়া গাড়িগুলি রোজগার করতো মোটা অঙ্কের টাকা। শ্রমিকরাও প্রতিদিন কাজ পেতেন। এই ব্যবসা বন্ধ হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্থানীয় পরিবহণ সংস্থা ও শ্রমজীবীরা। সরকারের এতে কোনও আর্থিক ক্ষতি না হলেও, স্থানীয় স্তরে প্রভাব বিশাল।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা সরকারী নির্দেশ মেনে চলতে বাধ্য। তবে সরকারের উচিত ছিল বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা। হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রমিকদের জীবিকা সঙ্কটে পড়েছে।”
পেট্রাপোল বন্দরের এক পরিবহণ সংস্থার মালিক জানান, “গত চার বছরে এই ট্রান্সশিপমেন্টের উপর নির্ভর করে আমাদের ব্যবসা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। আমরা নতুন ট্রাক কিনেছি, লোন নিয়েছি। এখন কাজ না থাকায় লোন শোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।”
পেট্রাপোল সীমান্তে কাজ করা দুই থেকে তিন হাজার শ্রমিক দৈনিক ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় করতেন। এখন কেউ কেউ টোটো চালিয়ে, কেউ কায়িক শ্রমে কোনওরকমে সংসার টিকিয়ে রাখছেন। উত্তর বনগাঁর বিজেপি বিধায়কও স্বীকার করেছেন যে বহু মানুষ জীবিকা হারিয়েছেন, তবে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত ‘দেশের স্বার্থে’ বলেই মেনে নেওয়ার কথা বলেছেন।
এই পরিস্থিতিতে পেট্রাপোল বন্দরের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিশেষত, যারা সম্পূর্ণভাবে ট্রান্সশিপমেন্ট নির্ভর ছিলেন, তারা এখন বিকল্প কর্মসংস্থানের সন্ধানে রয়েছেন। অনেকেই সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছেন, যেন পুনরায় ট্রান্সশিপমেন্ট চালু করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হয় অথবা স্থানীয় কর্মসংস্থানের জন্য বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়।
বাংলাদেশেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পের ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, বেনাপোল সীমান্ত দিয়েই বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ পোশাক ভারতে যেত। গত ১০ মাসে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছিল এই পথে। এখন সেই বাণিজ্য জলপথে যেতে সময় লাগছে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত, ফলে ব্যবসায়ীদের লোকসান বাড়ছে। একইসঙ্গে সমস্যা দেখা দিয়েছে কাঁচামাল আমদানিতেও, কারণ শান্তিনিকেতন, হাওড়া ও বড়বাজার থেকে যেসব কাপড় বাংলাদেশে যেত, তাও বন্ধ রয়েছে।
কলকাতার বড়বাজারের পোশাক ব্যবসায়ী সুরেন্দ্র গুপ্ত বলেন, “দিল্লি-মুম্বইয়ের বড় বাজারে যত পোশাক বিক্রি হয়, তার বেশিরভাগই আসে বাংলাদেশ থেকে। কারণ ওদের উৎপাদন খরচ কম।”
বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ৭০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করে ভারতে, যার ৯৩ শতাংশ আসত স্থলপথে। এখন এই প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুই দেশের পোশাক ও পরিবহন শিল্পে পড়েছে চরম নেতিবাচক প্রভাব।
সীমান্তে কর্মহীন মানুষের প্রশ্ন, “আর কতদিন এভাবে থাকব?”
এই পরিস্থিতির দ্রুত সমাধান না হলে দুই দেশের অর্থনীতি ও মানুষের জীবনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।