বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের আমন্ত্রণে সোমবার মালয়েশিয়ায় সরকারি সফরে যাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই গুরুত্বপূর্ণ সফরে প্রতিরক্ষা, জ্বালানি, হালাল খাদ্যসহ বিভিন্ন খাতে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) এবং তিনটি নোট বিনিময় করার পরিকল্পনা রয়েছে। সফরটি কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে দুই দেশের সম্পর্ককে শক্তিশালী করার জন্য একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার প্রত্যাশা
ঢাকা ও কুয়ালালামপুরের কূটনৈতিক সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, সফরের পরদিন মঙ্গলবার মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ও বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী পাঠানোর জটিলতা নিরসন, প্রতিরক্ষা খাতের সহযোগিতা, জ্বালানি খাতে যৌথ বিনিয়োগ, উচ্চশিক্ষা খাতের উন্নয়ন, রোহিঙ্গাসংকটের সমাধান, কৃষি প্রযুক্তি বিনিময়, হালাল খাদ্য শিল্প ও সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হবে। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে আসিয়ান ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সহযোগিতার বিষয়ে পথ খোঁজা হবে।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও সফরের গুরুত্ব
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার মাত্র দুই মাস পর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ঢাকায় সফর করেন, যা অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে প্রথম কোনো বিদেশি সরকারপ্রধানের সফর হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এবারের মালয়েশিয়া সফরটি সেই সম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে দুই দেশের সরকারপ্রধানের মধ্যে গড়ে ওঠা ‘ভালো রসায়ন’ কাজে লাগিয়ে পারস্পরিক স্বার্থে দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার কাঠামো গড়ে তোলার প্রচেষ্টা হিসেবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার প্রসারণে এই সফর একটি বড় ধাপ হবে। এছাড়া গত এক মাসে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে মালয়েশিয়ায় গ্রেপ্তার ও দেশে ফেরত পাঠানো বাংলাদেশি কর্মীদের পরিস্থিতি নিয়েও স্পষ্ট আলোচনা হবে। ঢাকার পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে কুয়ালালামপুরকে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
সমঝোতা স্মারক ও নোট বিনিময়
সফরে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি, জ্বালানি খাতে যৌথ উদ্যোগ, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ও কৌশলগত গবেষণা সংস্থা (বিআইআইএসএস) ও মালয়েশিয়ার সমতুল্য সংস্থার মধ্যে সহযোগিতা, বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিএমসিসিআই) ও মালয়েশিয়ার মিমোসের মধ্যে প্রযুক্তি বিনিময়, এবং বাংলাদেশ-এফবিসিসিআই ও মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে বাণিজ্য সহযোগিতা চুক্তি।
তাছাড়া তিনটি নোট বিনিময়ের মধ্যে রয়েছে হালাল খাদ্য ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা, ফরেন সার্ভিস একাডেমি ও ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমেসি অ্যান্ড ফরেন রিলেশনসের (আইডিএফআর) মধ্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সহযোগিতা, এবং উচ্চশিক্ষা খাতে উন্নয়ন নিয়ে সমঝোতা।
শ্রমবাজার ও রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সমাধানের প্রত্যাশা
সফরে মালয়েশিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা বাংলাদেশি শ্রমিক পাঠানোর সমস্যা সমাধানে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে বলে কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে। মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষকে এই সংকট নিয়ে বিস্তারিত অবহিত করা হবে। রোহিঙ্গাসংকট নিয়ে মালয়েশিয়ার সহযোগিতা চাওয়ার বিষয়টিও আলোচনায় গুরুত্ব পাবে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মালয়েশিয়ার মতো দেশের সহযোগিতা রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে বড় ভূমিকা রাখবে।
উচ্চাকাঙ্ক্ষী কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও সম্ভাব্য ফলাফল
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সফর বাংলাদেশের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ মালয়েশিয়া দীর্ঘদিন ধরে দেশের অন্যতম বৃহৎ শ্রমবাজার। এর পাশাপাশি জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগ ও বাংলাদেশিদের গ্রেপ্তারের প্রেক্ষাপটে দুই দেশের মধ্যে সুরাহা প্রয়োজন। পাশাপাশি, প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি বিনিময়, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের যৌথ বিনিয়োগ এবং ব্লু ইকোনমি ও আধুনিক কৃষি প্রযুক্তিতে সহযোগিতার মাধ্যমে দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরও সমৃদ্ধ করা যাবে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই সফর থেকে আমরা আশা করি অনেক বাধা দূর হবে। দুই দেশের সরকারপ্রধানের মধ্যে যে রসায়ন আছে, আমরা সেটি কাজে লাগাতে চাই।’
সম্মানসূচক ডক্টরেট ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা
সফরকালে ইউনিভার্সিটি কেবাংসান মালয়েশিয়া (ইউকেএম) প্রধান উপদেষ্টাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করবে। এছাড়া মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর পর প্রধান উপদেষ্টাকে গার্ড অব অনার দেয়া হবে। বাংলাদেশ কমিউনিটির সঙ্গে মতবিনিময় সভা, বাংলাদেশ দূতাবাস ও মালয়েশিয়ার মন্ত্রীরা সঙ্গে বৈঠক এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে সাক্ষাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
পরিবহন, আইন ও জ্বালানি খাতের উপদেষ্টা ও অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সফরে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে থাকবেন। সফর শেষে ১৩ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা ঢাকায় ফিরে আসবেন।
মালয়েশিয়ায় মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসার উদ্বোধন
এর আগে মালয়েশিয়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুক্রবার এক বিবৃতিতে জানায়, বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা (এমইভি) চালু করা হয়েছে। এটি শ্রমিকদের যাতায়াত প্রক্রিয়া সহজ করবে, ইমিগ্রেশন পাসের অপব্যবহার রোধ করবে এবং সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করবে। এতে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশি মিশনগুলোর নতুন ভিসা আবেদনের চাপও কমবে।
এই সফরকে দুই দেশের সম্পর্কের নতুন দিগন্ত হিসেবে দেখছে কূটনৈতিক মহল। বিশেষ করে শ্রমবাজার প্রসারণ, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলা ও প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভবিষ্যতে আরও সমৃদ্ধ সহযোগিতার পথ প্রশস্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।