খরা ও বন্যার জোড়া থাবায় অস্তিত্বের লড়াই
বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর কেবল বৈশ্বিক আলোচনার বিষয় নয়, বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ খাতের জন্য এটি এক জীবন্ত সংকট। উত্তরবঙ্গের তীব্র খরা থেকে শুরু করে উপকূলের লবণাক্ততা—প্রকৃতির এই বৈরী আচরণে দিশেহারা দেশের লাখ লাখ খামারি। উচ্চ তাপমাত্রা আর আকস্মিক বন্যায় একদিকে যেমন গবাদিপশুর জীবন বিপন্ন হচ্ছে, অন্যদিকে কমছে দুধ ও মাংসের উৎপাদন, যা সরাসরি আঘাত করছে জাতীয় খাদ্যনিরাপত্তায়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) সাম্প্রতিক এক মূল্যায়ন অনুযায়ী, তাপমাত্রা মাত্র ১–২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে উচ্চ উৎপাদনশীল জাতের গরুর দুধ উৎপাদন ১০–২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর (DLS) বলছে, উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দীর্ঘস্থায়ী খরায় ঘাস উৎপাদন কমে যাওয়ায় তীব্র খাদ্যসংকট তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে নষ্ট হচ্ছে চারণভূমি, যার ফলে পশুখাদ্য কিনতে খামারিদের গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা।
আকস্মিক বন্যায় দেশের চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের খামারগুলো প্রায়ই পানির নিচে তলিয়ে যায়। বিশ্ব প্রাণিস্বাস্থ্য সংস্থা (WOAH)-এর বিশ্লেষণ বলছে, বন্যার পরবর্তী সময়ে আর্দ্রতা ও নোংরা পানির কারণে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া এবং ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। বন্যার সময় পশুকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া এবং শুকনো খাদ্যের জোগান দেওয়া খামারিদের জন্য এক দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পশুখাদ্যের ওপর সৃষ্টি হওয়া প্রভাবকে বিশেষজ্ঞরা দেখছেন দীর্ঘমেয়াদি হুমকি হিসেবে।
খরা মৌসুমে: মাঠের ঘাস শুকিয়ে যাওয়ায় পুষ্টিহীনতায় ভোগে পশু।
বর্ষা মৌসুমে: অতিবৃষ্টিতে ঘাস পচে যায় এবং গোখাদ্য সংরক্ষণে জটিলতা দেখা দেয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংকট কাটাতে সাইলেজ (সংরক্ষিত ঘাস), হে এবং কম পানি-নির্ভর উচ্চ তাপ প্রতিরোধী ঘাসের জাত উদ্ভাবন এখন সময়ের দাবি।
সঙ্কট মোকাবিলায় সরকার ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। FAO ও DLS-এর সাম্প্রতিক এক প্রকল্পে দেখা গেছে:
তাপ নিয়ন্ত্রণ: খামারে উন্নত বায়ু চলাচল ও শেডিংয়ের ব্যবস্থা করলে দুধ উৎপাদন ১২–১৫ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব।
আশ্রয়কেন্দ্র: প্লাবনপ্রবণ এলাকায় উচ্চভূমিতে গবাদিপশুর জন্য বিশেষ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।
সহনশীল জাত: জলবায়ু-সহনশীল ও স্থানীয় আবদাওয়ায় টিকে থাকতে সক্ষম পশুর জাত সম্প্রসারণ করা হচ্ছে।
প্রাণিসম্পদ খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কেবল সরকারি সাহায্য নয়, বরং দরকার একটি সমন্বিত ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম। আগাম রোগ সতর্কতা, পানি সংরক্ষণ এবং স্থানীয় পর্যায়ে খামারিদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রদানই পারে এই খাতের ভবিষ্যৎ বদলে দিতে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলে প্রাণিসম্পদ খাতকে টিকিয়ে রাখা মানে কেবল কৃষকের জীবিকা বাঁচানো নয়, এটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির সুরক্ষাকবচ। বিনিয়োগ ও উদ্ভাবনী অভিযোজন কৌশলের মাধ্যমেই সম্ভব এই বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা।
এ ধরণের আরও গুরুত্বপূর্ণ আপডেট পেতে ভিজিট করুন www.businesstoday24.com










