প্রেম, প্রলোভন ও গুপ্তচরবৃত্তি: সেক্স স্পাইয়ের গোপন ইতিহাস
পর্ব ৩:
তারিক-উল-ইসলাম:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটার পর পৃথিবী যেন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়—একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা, অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট ব্লক। এই দুই পরাশক্তির মধ্যে শুরু হয় “ঠান্ডা যুদ্ধ”—এক অদৃশ্য লড়াই, যেখানে বন্দুকের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে তথ্য, প্রযুক্তি, আর প্রলোভন। এই সময়েই সেক্স স্পাই কার্যক্রম পৌঁছে যায় তার সোনালি যুগে।
গোপন যুদ্ধের গোপন অস্ত্র
ঠান্ডা যুদ্ধ মানেই ছিল সন্দেহ, ভয় ও মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ (CIA) ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কেজিবি (KGB) তখন বিশ্বের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে রেখেছিল তাদের গুপ্তচর নেটওয়ার্ক। আর সেই নেটওয়ার্কের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র হয়ে ওঠে “হানিট্র্যাপ”—যেখানে প্রেম ও আকর্ষণ ব্যবহার করা হতো রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য উদ্ধারের জন্য।
কেজিবি-র হাতে প্রশিক্ষিত ছিল এমন নারী গুপ্তচরদের দল, যারা পশ্চিমা কূটনীতিক, বিজ্ঞানী বা সামরিক কর্মকর্তাদের প্রেমে ফেলে তথ্য আদায় করতেন। অন্যদিকে, পশ্চিমা দেশগুলিও একই কৌশল ব্যবহার করত সোভিয়েত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে খবর বের করতে।
ক্রিস্টিন কিলার: প্রেম, কেলেঙ্কারি ও পতন
১৯৬৩ সালের ব্রিটেন। এক তরুণী নর্তকী ক্রিস্টিন কিলার লন্ডনের রাজনীতিক ও সামরিক মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জন প্রফিউমো এবং একই সময়ে সোভিয়েত দূতাবাসের কর্মকর্তা ইভগেনি ইভানোভ-এর। এই সম্পর্ক ফাঁস হলে “প্রফিউমো অ্যাফেয়ার” নামে কেলেঙ্কারিতে কেঁপে ওঠে পুরো যুক্তরাজ্য।
এই ঘটনার পর প্রফিউমো পদত্যাগ করেন, সরকার বিপাকে পড়ে, এবং ঠান্ডা যুদ্ধের গুপ্তচরবৃত্তির জগতে “সেক্স স্ক্যান্ডাল” হয়ে ওঠে সবচেয়ে আলোচিত অস্ত্র। ক্রিস্টিন কিলারকে ইতিহাস আজও চেনে এক “অজান্তে ব্যবহৃত সেক্স স্পাই” হিসেবে।
কেজিবি-র রূপসী গুপ্তচররা
সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি প্রশিক্ষণ দিত এমন নারীদের, যারা বিদেশি দূতাবাস, সামরিক ঘাঁটি বা সম্মেলনে কৌশলে প্রলোভন তৈরি করতেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল—লক্ষ্যবস্তুকে ব্ল্যাকমেইল করে তথ্য আদায় করা। এই কৌশলকে বলা হতো “সোয়ালো অপারেশন” (Swallow Operation)।
১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে এই কৌশল এতটাই সফল হয় যে, পশ্চিমা দেশগুলো তাদের কর্মকর্তাদের সতর্ক করত: “If she’s too charming, she might be KGB.”
আনা চ্যাপম্যান ও আধুনিক প্রতিচ্ছবি
ঠান্ডা যুদ্ধের পরও এই কৌশল হারিয়ে যায়নি। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ধরা পড়া রাশিয়ান গুপ্তচর আনা চ্যাপম্যান যেন সেই ঐতিহ্যের আধুনিক প্রতীক। তিনি সামাজিক যোগাযোগ ও ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে মার্কিন নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করছিলেন। তাঁর গল্প প্রমাণ করে, ঠান্ডা যুদ্ধের প্রলোভনের রাজনীতি এখনো বেঁচে আছে আধুনিক কূটনীতির অন্দরমহলে।
প্রেমের ছায়ায় যুদ্ধ
ঠান্ডা যুদ্ধের সেক্স স্পাইদের গল্পে প্রেম, প্রতারণা ও রাজনীতি একাকার হয়ে যায়। কখনো তারা ছিলেন নিজের দেশের জন্য আত্মোৎসর্গী যোদ্ধা, আবার কখনো কেবল ব্যবহৃত এক মাধ্যম। এই অদৃশ্য যুদ্ধের ফ্রন্টলাইন ছিল না সীমান্তে, বরং বিলাসবহুল হোটেল, পার্টি কিংবা কারও ব্যক্তিগত শয়নকক্ষে।
ঠান্ডা যুদ্ধ প্রমাণ করেছে, গুপ্তচরবৃত্তি মানে কেবল গোপন অস্ত্র বা কোড নয়—মানুষের আবেগ, প্রেম ও দুর্বলতাও হয়ে উঠতে পারে অস্ত্র। সেক্স স্পাই কার্যক্রম সেই আবেগের সর্বোচ্চ ব্যবহার।
পরবর্তী পর্ব: ডিজিটাল যুগের হানিট্র্যাপ – যখন প্রলোভন চলে আসে সাইবার জগতে, আর গুপ্তচরবৃত্তি হয়ে ওঠে ভার্চুয়াল প্রেমের খেলায়।










