Home বিনোদন সুন্দরবনের জীবন-আখ্যান ‘বনবিবি পালা’

সুন্দরবনের জীবন-আখ্যান ‘বনবিবি পালা’

মানুষ-প্রকৃতির সংঘাতের মহাকাব্য

কৃষ্ণা বসু, কলকাতা: সুন্দরবনের শ্বাসমূলের গভীরে, ঘন ম্যানগ্রোভ অরণ্যের ছায়ায়, জীবন যখন প্রতি মুহূর্তে এক অনিশ্চিত সংগ্রাম, তখন মানুষের মুখে মুখে ফেরে এক দেবীর কাহিনি, তিনি বনবিবি। তাঁরই বন্দনা এবং দেবত্বকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এক বিশেষ লোকনাট্য ধারা, যা ‘বনবিবি পালা’ নামে পরিচিত। এটি কেবল একটি পৌরাণিক অভিনয় নয়, বরং প্রকৃতির ভয়ঙ্কর শক্তির সঙ্গে এক সংকটাপন্ন জনজাতির টিকে থাকার এক যৌথ ও আত্মিক চুক্তির দলিল।

জঙ্গলের মাঝের মঞ্চ: জীবন ও মৃত্যুর নাটক

সুন্দরবনের যে সমস্ত মানুষ কাঠ কাটতে, মধু সংগ্রহ করতে বা মাছ ধরতে জঙ্গলে প্রবেশ করেন—যাঁরা ‘বনজীবী’ নামে পরিচিত—তাঁদের জীবন প্রকৃতির সীমারেখায় অত্যন্ত ঝুঁকির মুখে। বাঘ, কুমির, আর সাপের নিরন্তর আতঙ্ক নিয়ে এই জীবিকার পথ। আর এই আতঙ্কের মূলে রয়েছে বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায় । বনবিবি পালা মূলত এই দুই শক্তির—রক্ষক দেবী বনবিবি এবং শিকারী দেবতা দক্ষিণ রায়ের—মধ্যে এক চিরন্তন দ্বন্দ্বের মহাকাব্য।

সন্ধ্যার পর গ্রামের এক খোলা মাঠে বা অস্থায়ী মঞ্চে শুরু হয় এই পালা। মঞ্চসজ্জা হয় সরল, কিন্তু আবেগের তীব্রতা থাকে অপ্রতিরোধ্য। ঢোল, কাঁসি আর হারমোনিয়ামের সুরে শুরু হয় আখ্যান। অভিনেতাদের পরনে থাকে জমকালো, ঝলমলে পোশাক এবং অলঙ্কার। বনবিবির শান্ত, অথচ শক্তিশালী রূপটি ফুটিয়ে তোলা হয় উজ্জ্বল মুকুট ও বস্ত্রের মাধ্যমে। অন্যদিকে, দক্ষিণ রায়ের চরিত্রটি আসে ভয়ঙ্কর বাঘের মুখোশ পরে, যা সুন্দরবনের অদম্য এবং ক্ষিপ্র শক্তিকে তুলে ধরে।

কাহিনির মূল সুর: বিশ্বাসে বাঁচি, নির্ভয়ে চলি

বনবিবি পালার মূল কাহিনি আবর্তিত হয় গরিব দুখে এবং লোভী বণিক ধনাই-কে ঘিরে। ধনাই লোভে পড়ে দুখেকে সুন্দরবনের গভীরে বাঘের হাতে তুলে দিতে চায়। অসহায় দুখে তখন বনবিবিকে স্মরণ করে। দেবী বনবিবি তাঁর ভাই শাহ জঙ্গলি-কে নিয়ে আবির্ভূত হন এবং দক্ষিণ রায়ের কবল থেকে দুখেকে রক্ষা করেন। এই পালাটি আসলে দেখায় যে, বনবিবির প্রতি বিশ্বাস এবং বনের নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমেই কেবল বনজীবীরা রক্ষা পেতে পারে। লোভ, অনিয়ম ও অবিশ্বাসের পরিণতি যে ভয়ঙ্কর হয়, সেই শিক্ষাই দেয় এই লোকনাট্য।

পালা চলাকালীন, বাঘের মুখোশ পরা দক্ষিণ রায়ের অভিনেতার মঞ্চে ক্ষিপ্র গতি, গর্জন ও আক্রমণাত্মক ভঙ্গিমা দর্শকদের মনকে ভয়ের এক গাঢ় আবহে জড়িয়ে ফেলে। তখনই বনবিবির শান্ত হস্তক্ষেপ এবং চূড়ান্ত জয়, দর্শকদের মনে সঞ্চার করে গভীর স্বস্তি ও আস্থা। এই নাটকীয় টানাপোড়েনই পালার প্রাণ।

এক অনন্য সাংস্কৃতিক সমন্বয়

বনবিবি পালার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো এর সাংস্কৃতিক সমন্বয়। বনবিবি কোনো একক হিন্দু বা মুসলিম ঐতিহ্যের দেবী নন; তিনি সুন্দরবনের সর্বজনীন দেবী। এই পালার কাহিনিতে যেমন বনবিবির মুসলিম ভাই শাহ জঙ্গলি রয়েছেন, তেমনি রয়েছে দুখে ও ধনাই-এর মতো হিন্দু চরিত্র। হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই সমান নিষ্ঠা ও ভয়ভক্তির সঙ্গে বনবিবির পূজা করে এবং তাঁর পালা পরিবেশন করে।

এই সমন্বয় নিছক ধর্মীয় সহাবস্থান নয়; এটি জীবনধারণের তাগিদে তৈরি হওয়া এক সমাজ-মনস্তত্ত্ব। জীবন যখন একই নদী ও জঙ্গলের নিয়মে বাঁধা, তখন বিশ্বাসের পথও এক হয়ে যায়। বনবিবি পালা সুন্দরবনের মানুষকে মনে করিয়ে দেয় যে, প্রকৃতির কাছে তাঁরা সবাই সমান এবং কেবল সম্মিলিত বিশ্বাস ও নিয়মানুবর্তিতাই তাদের টিকে থাকার একমাত্র উপায়।

লোকনাট্য না জীবন-দর্শন?

বনবিবি পালা শুধু একটি লোকনাট্য নয়, এটি সুন্দরবনের মানুষের জীবন-দর্শন। এটি লোকশিক্ষার মাধ্যম, যার দ্বারা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে শেখানো হয় বনের সঙ্গে কীভাবে সহাবস্থান করতে হয়। প্রতিটি পারফরম্যান্সের মাধ্যমে স্থানীয় শিল্পীরা তাঁদের ঐতিহ্যের গভীরতাকে বহন করে চলেন, যা আজও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে লোকায়ত সমাজের গভীরে টিকে আছে।

যখন নাটক শেষে মঞ্চের আলো নেভে এবং গ্রামবাসীরা গভীর রাতে ঘরে ফেরে, তখন তাদের হৃদয়ে বনবিবির আশ্বাস এবং দক্ষিণ রায়ের আতঙ্ক উভয়ই বর্তমান থাকে। এই পালা তাদের মনে করিয়ে দেয়, বাঘের মুখ থেকে রক্ষা পেতে হলে প্রকৃতির সম্পদ আহরণের সময় শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং তার সীমারেখা লঙ্ঘন করা চলবে না। যতক্ষণ সুন্দরবনের অস্তিত্ব থাকবে, ততক্ষণ এই পালাও হয়তো টিকে থাকবে—মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যের এই চিরন্তন চুক্তির মহাগীত হিসেবে।