নয়ন দাস, কুড়িগ্রাম: উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, রংপুর, লালমনিরহাট ও দিনাজপুর জেলাজুড়ে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। উজানের ঢল ও টানা বৃষ্টিতে তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্র নদে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। নিম্নাঞ্চলগুলো পানিতে তলিয়ে পড়েছে, ঘরবাড়ি, ফসল ও সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
নদীতে ভেসে আসছে গাছের গুঁড়ি
কুড়িগ্রামের চিলমারী, নাগেশ্বরী ও ভুরুঙ্গামারীতে ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদে ভেসে আসছে হাজার হাজার গাছের গুঁড়ি। স্থানীয়রা নৌকা ও দড়ি ব্যবহার করে এসব গাছ সংগ্রহ করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, প্রবল স্রোতে ভুটানের কালজানী ও ভারতের হাসিমারা বনাঞ্চল থেকে উপড়ে যাওয়া গাছগুলো নদীপথে ভেসে এসেছে।
নাগেশ্বরীতে গাছ তোলার সময় পানিতে পড়ে নিখোঁজ হয়েছেন মনছুর আলী (৪০)। স্থানীয় চেয়ারম্যান ইউসুফ আলী বলেন, “নদীজুড়ে শুধু গাছ আর গাছ। এমন দৃশ্য জীবনে দেখি নাই।”
তিস্তা নদীতে রেড অ্যালার্ট
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে গত রোববার রাতে পানি বিপৎসীমার (৫২.১৫ সেমি) ৩৬ সেন্টিমিটার ওপরে প্রবাহিত হয়, যা পরদিন কিছুটা কমে বিপৎসীমার নিচে নামে। তবে নদীর পানি এখনও বিপৎসীমার কাছাকাছি থাকায় ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি রাখা হয়েছে।
গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় তিস্তার পানি বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। আগামী তিন দিনে তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমারের পানি কিছুটা কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
গঙ্গাচড়ায় চার হাজার পরিবার পানিবন্দি
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার সাত ইউনিয়নের প্রায় চার হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অনেকেই গবাদিপশু ও আসবাবপত্র নিয়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। উপজেলা প্রশাসন মাইকিং করে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে সতর্কবার্তা দেয়।
গঙ্গাচড়ার ইউএনও মাহমুদ হাসান মৃধা জানান, পানিবন্দি পরিবারগুলোর জন্য ১২ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
রংপুরে ঝড়ে ক্ষতি
গত রোববার সকাল থেকে টানা বৃষ্টি ও আকস্মিক ঝড়ে রংপুরের গঙ্গাচড়ার আলমবিদিতর ও নোহালী ইউনিয়নে সাত শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। টিনশেড ও আধাপাকা ঘর ভেঙে পড়েছে, গাছপালা উপড়ে গেছে। শিক্ষার্থীরা ভেজা বই-খাতা শুকাচ্ছে, কেউ খোলা জায়গায় রান্না করছে।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য ৮ টন চাল ও শুকনো খাবার বিতরণ শুরু হয়েছে।
লালমনিরহাটে পাঁচ হাজার পরিবার পানিবন্দি
লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চলে প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার জানান, ভাঙন ঠেকাতে বালির ব্যাগ ও জিওব্যাগ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, পর্যাপ্ত ত্রাণ ও শুকনো খাবার মজুত রাখা হয়েছে।
দিনাজপুরে কৃষিক্ষেত্রের ক্ষতি
টানা বৃষ্টিতে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে আগাম আমন ধান, আলু ও শীতকালীন সবজির ক্ষতি হয়েছে। ধানক্ষেত ডুবে নষ্ট হচ্ছে, আলু বীজ পচে যাচ্ছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফ আব্দুল্লাহ জানান, “কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতায় পাকা ধানের ক্ষতি হয়েছে। পানি নেমে গেলে পরিস্থিতি উন্নতি হবে।”
দহগ্রামে রাস্তা ও সেতু ভেঙে গেছে
লালমনিরহাটের দহগ্রাম ইউনিয়নের অন্তত ১০টি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানির তোড়ে প্রায় ৭ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, একটি সেতু ও দুটি কালভার্ট ভেঙে গেছে। প্রায় ১০ হেক্টর আমন ধান ও বাদামক্ষেত তলিয়ে গেছে।
ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী তিন দিন দেশের ভেতরে এবং ভারতের উজানে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।