Home আন্তর্জাতিক গোপন বাঙ্কারে চিকিৎসা: মৃত্যু আর জীবনের মাঝখানে ইউক্রেনের সৈন্যরা

গোপন বাঙ্কারে চিকিৎসা: মৃত্যু আর জীবনের মাঝখানে ইউক্রেনের সৈন্যরা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: পূর্ব ইউক্রেনের ডনেস্ক অঞ্চলে, রুশ হামলার সামনের সারির কাছাকাছি, এক টুকরো গাছপালার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক আশ্চর্য স্থান, একটি গোপন ভূগর্ভস্থ হাসপাতাল। কাঠের ঢালু টানেল বেয়ে নিচে নামলেই দেখা মেলে আলোকিত এক রিসেপশন কক্ষ, যেখানে সারিবদ্ধভাবে সাজানো রয়েছে চিকিৎসা সরঞ্জাম, ওষুধ, মনিটর, ভেন্টিলেটর, এমনকি পরিষ্কার কাপড়ের স্তূপ। পাশে ছোট এক স্টাফ রুমে ধোয়ার মেশিন, কেটলি, আর মনিটরে চোখ রাখা চিকিৎসকরা, যারা উপর আকাশে ঘুরে বেড়ানো রুশ গুপ্তচর ড্রোনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেন।

এই হাসপাতালটি খোলা হয়েছে চলতি বছরের আগস্টে। এটি ইউক্রেনের দ্বিতীয় ভূগর্ভস্থ মেডিক্যাল ইউনিট, যা মাটির প্রায় ছয় মিটার নিচে অবস্থিত। সার্জন মেজর ওলেক্সান্দর হোলোভাশচেঙ্কো বলেন, “এটাই আহত সৈন্যদের নিরাপদে চিকিৎসা দেওয়ার সবচেয়ে কার্যকর উপায়। এতে আমাদের কর্মীদের জীবনও সুরক্ষিত থাকে।”

প্রতিদিন এখানে ৩০ থেকে ৪০ জন আহত সৈন্যকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। অনেকের পা কেটে ফেলতে হয়, কারও পেটে মারাত্মক আঘাত, আবার কেউ নিজের পায়ে হেঁটে আসে। প্রায় সব রোগীই রুশ ফার্স্ট পারসন ভিউ (FPV) ড্রোন হামলার শিকার। “আমাদের ৯০ শতাংশ রোগী FPV ড্রোনে আহত। গুলির আঘাত এখন খুবই কম দেখা যায়। যুদ্ধ এখন ড্রোনের যুগে প্রবেশ করেছে,” বলেন হোলোভাশচেঙ্কো।

এক বিকেলে তিনজন সৈন্য এসে পৌঁছান হাসপাতালে। তাদের একজন, ২৮ বছর বয়সী আরতেম দ্বর্স্কিই, বলেন, “ড্রোন বিস্ফোরণে আমার পায়ে ছোট একটি গর্ত হয়ে গেছে। আমার পাশে থাকা ভাসিল মারা যায়। রুশরা দ্বিতীয় গ্রেনেডও ফেলে।” আহত হওয়ার পর তিনি তিন ঘণ্টা হেঁটে পাঁচ কিলোমিটার দূরের জায়গায় পৌঁছান, যেখানে সাঁজোয়া গাড়ি তাকে তুলে নেয়। হাসপাতালে চিকিৎসার পর তাকে নতুন পোশাক দেওয়া হয়, একটি টি-শার্ট ও হালকা নীল জিন্স।

অন্য এক রোগী, ৩৮ বছর বয়সী পাভলো ফিলিপচুক, মাথায় আঘাত পেয়ে অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। তিনি বলেন, “সবকিছু অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। কিছু শুনতে পাইনি। আমার ভাগ্য ভালো যে বেঁচে আছি।” লিথুয়ানিয়ায় নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন তিনি, কিন্তু রুশ আগ্রাসনের পরপরই দেশে ফিরে যুদ্ধের ময়দানে যোগ দেন।

আরেকজন সৈন্য, তারাস মাইকোলাইচুক, পিঠে মর্টারের টুকরায় আহত হন। চিকিৎসকেরা রক্তাক্ত ব্যান্ডেজ খুলে ক্ষত পরিষ্কার করেন। তিনি মোবাইল ফোনে বোনকে জানান, “আমি ভালো আছি। কিছুটা সময় লাগবে সুস্থ হতে, তারপর আবার ফ্রন্টলাইনে ফিরব। দেশকে তো কেউ না কেউ রক্ষা করতে হবে।”

রাশিয়া ২০২২ সালের আগ্রাসনের পর থেকে ইউক্রেনের হাসপাতাল, ক্লিনিক, মাতৃসদন ও অ্যাম্বুলেন্সে প্রায় দুই হাজার হামলা চালিয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ২৬১ জন স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হয়েছেন। এই ভূগর্ভস্থ হাসপাতালটি চারটি ইস্পাত বাঙ্কার দিয়ে তৈরি, যার ওপর মাটি ও বালির স্তর রয়েছে। এটি সরাসরি ১৫২ মিলিমিটার কামানের গোলা কিংবা ড্রোন থেকে পড়া ৮ কেজি টিএনটি বিস্ফোরণও সহ্য করতে পারে।

এই প্রকল্পটি অর্থায়ন করেছে ইউক্রেনের স্টিল ও খনিশিল্প প্রতিষ্ঠান মেটইনভেস্ট। প্রতিষ্ঠানটি আরও ২০টি এমন হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। ইউক্রেনের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান রুস্তেম উমেরভ বলেন, “এই প্রকল্প আমাদের সেনাদের জীবন বাঁচাতে এবং ফ্রন্টলাইনে টিকে থাকতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

হোলোভাশচেঙ্কো জানান, অনেক সময় আহত সৈন্যদের পৌঁছাতে ঘন্টার পর ঘন্টা বা দিনের পর দিন লেগে যায়, কারণ আকাশে ক্রমাগত ড্রোনের ঝুঁকি। “এক রাতে আমি একজন সৈন্যের ডাবল অ্যামপুটেশন করি। তার টুর্নিকেট এতক্ষণ ধরে বাঁধা ছিল যে অন্য কোনো উপায় ছিল না,” বলেন তিনি।

চিকিৎসা শেষে আহত সৈন্যদের অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নেওয়া হয়, যানটি ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রাখা। তারা শহর ডিনিপ্রোতে পাঠানো হয় পরবর্তী চিকিৎসার জন্য। একটু অবসর নিয়ে হাসপাতালের আদুরে বিড়াল ভাসিলেভ দরজার কাছে এসে বসে, নতুন রোগীর অপেক্ষায়। সার্জন মেজর হোলোভাশচেঙ্কো বলেন, “আমরা ২৪ ঘণ্টা খোলা। যুদ্ধ থামে না, আমরাও থামি না।”