কলকাতার বাবু কালচার-১
কৃষ্ণা বসু, কলকাতা: ১৮শ শতকের শেষভাগ থেকে ১৯শ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কলকাতার সমাজে এক বিশেষ শ্রেণির উত্থান ঘটে, যাদের বলা হয় বাবু। এঁরা মূলত জমিদার বা ধনী ব্যবসায়ী পরিবার থেকে উঠে আসা অভিজাত শ্রেণি, যারা ইংরেজ শাসনের ছত্রছায়ায় বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু এই সম্পদের একটি বড় অংশ তারা ব্যয় করতেন বিলাসিতা আর আভিজাত্যের প্রদর্শনে। সাধারণ জীবনে তারা ছিলেন অত্যন্ত বেহিসেবি, যার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল টাকা উড়ানো।
বাবুরা শুধু খরচ করতেন না, খরচটাকেই তারা এক ধরনের গৌরবের আসনে বসিয়ে রেখেছিলেন। কার কত বেশি টাকা উড়ানো সম্ভব, তা-ই হয়ে উঠত প্রতিযোগিতার মাপকাঠি। এই প্রতিযোগিতা দেখা যেত প্রতিদিনের জীবনযাত্রায়। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই শুরু হতো তাদের বিলাসী জীবন। রুপার পানপাত্রে পান চিবানো, সোনার হুঁকোয় সুগন্ধি তামাক টানা, সিল্ক আর মসলিনে মোড়ানো পোশাক পরা ছিল তাদের নিত্যদিনের অভ্যাস।
খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রেও বাবুরা ছিলেন ব্যতিক্রম। কেবলমাত্র অতিথি আপ্যায়ন নয়, নিজেদের জন্যও তারা সাজাতেন একাধিক পদ। রান্নার জন্য আনা হতো দামি মসলা, বিলিতি মদ, কখনো কখনো বিদেশ থেকে আনা বিশেষ খাদ্যদ্রব্য। রাজকীয় ভোজ আয়োজন করতেন অনেকেই, যেখানে শুধু খাওয়া নয়, প্রদর্শনীই ছিল মুখ্য বিষয়। কতটা অপচয় করা সম্ভব, কতটা টাকা খরচ করে অন্যকে চমকে দেওয়া যায়, সেটাই হয়ে উঠত মূল উদ্দেশ্য।
বিনোদনের ক্ষেত্রে বাবুরা ছিলেন আরও বেহিসেবি। নাচগান, মেহফিল, পালাগান আর নাট্যমঞ্চে তারা লক্ষ টাকা উড়িয়ে দিতেন। বিশেষ করে নাচঘরে বাবুরা প্রবল উৎসাহ দেখাতেন। গায়িকা ও নর্তকীদের জন্য সোনার গয়না থেকে শুরু করে রুপার মোহর বর্ষণ করা ছিল তাদের রীতি। শুধু তাই নয়, মাঝে মাঝেই বাবুরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন কে বেশি দামী উপহার দিতে পারেন সেই হিসেব কষে। এভাবে বিলাসিতার নামে অর্থ অপচয় চলত অবলীলায়।
শহরের রাস্তায় বের হলেও বাবুরা সাধারণভাবে চলাফেরা করতেন না। তাদের পালকি হতো রুপোর আস্তরণে মোড়া। পালকির সামনে থাকত বাজনার দল, থাকত আলোকসজ্জা। এক বাবু যখন শহরে বের হতেন, তখন পুরো পথটাই যেন তার ঐশ্বর্যের প্রদর্শনীতে পরিণত হতো। অন্য বাবুরা আবার এর চেয়ে বাড়তি কিছু করার চেষ্টা করতেন। এভাবে একটি প্রতিযোগিতা শহরের অভিজাত শ্রেণির মধ্যে গড়ে উঠেছিল, যেখানে টাকার মানে ছিল শুধুই উড়ানোর আনন্দ।
এই জীবনযাত্রা একদিকে তাদের সম্মানিত করেছিল ব্রিটিশ প্রভাবিত সমাজে, কিন্তু অন্যদিকে অতি অপচয়ের কারণে অনেকেই আর্থিকভাবে ধ্বংস হয়ে যান। জমিদারি থেকে আসা বিপুল অর্থ রাতারাতি উধাও হয়ে যায় বিলাসিতার অগ্নিকুণ্ডে। অনেক পরিবারের উত্তরসূরিরা পরবর্তী সময়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। আজ কলকাতার কিছু পুরোনো বাড়ি ও দালানকোঠা সেই বাবু সংস্কৃতির নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তাদের উড়নচণ্ডী জীবনের গল্প ইতিহাসের পাতায় এক সতর্কবার্তা হিসেবেই থেকে গেছে।
কলকাতার বাবুদের টাকা উড়ানোর এই সংস্কৃতি কেবল অতীতের গল্প নয়। এটি দেখায় কীভাবে বেহিসেবি বিলাসিতা সাময়িক গৌরব আনলেও তা টেকসই হয় না। যে ঐশ্বর্যের প্রদর্শন এক সময় সমাজকে চমকে দিয়েছিল, সেই ঐশ্বর্যই শেষ পর্যন্ত নিঃস্বতার গল্পে রূপ নিয়েছিল। তাই বাবু সংস্কৃতি আজ ইতিহাস হলেও তার মধ্যে লুকিয়ে আছে এক অমোঘ শিক্ষা—অপচয় কখনো দীর্ঘস্থায়ী সুখ এনে দেয় না।