বাবু কালচার-২
কৃষ্ণা বসু, কলকাতা: কলকাতার বাবুদের ইতিহাসে নাচঘর একটি আলাদা জায়গা দখল করে আছে। ১৮শ শতকের শেষভাগ থেকে শুরু করে ১৯শ শতক পর্যন্ত শহরের জমিদার ও বাবুরা শুধু বিলাসবহুল বাড়ি আর দামী জিনিসপত্রেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। তারা রাতের পর রাত আসর বসাতেন নাচনেওয়ালি ও গায়িকা–নর্তকীদের ঘিরে। এই আসরগুলো কেবল বিনোদন নয়, একরকম প্রতিযোগিতাও ছিল, যেখানে টাকার বৃষ্টি নামানোই ছিল বাবুদের আভিজাত্যের প্রতীক।
একটি বাবু আসরে প্রবেশ করলে চোখ ধাঁধিয়ে যেত। মেঝেতে বিছানো থাকত দামি কার্পেট, চারপাশে ঝাড়বাতির আলো, মাঝে বসে থাকতেন বাবুরা রুপো কিংবা সোনার হুঁকো হাতে। নাচ শুরু হতেই বাজতে থাকত সেতার, তবলা, সারেঙ্গি। গায়িকা গাইতেন ধ্রুপদী সঙ্গীত, আর নর্তকীরা কোমর দুলিয়ে পরিবেশন করতেন ঠুমরি বা কাওয়ালি। বাবুরা মুগ্ধ হয়ে ঝুড়ি ভরে টাকা ছুঁড়ে দিতেন। কেবল কাগুজে টাকা নয়, রুপার মোহর আর সোনার গয়নাও ছড়ানো হতো। কখনো কখনো মেঝেতে এমনভাবে টাকা জমে যেত যে, তা সংগ্রহ করার জন্য আলাদা কর্মচারী রাখা হতো।
এই নাচঘরগুলোতে বাবুরা কেবল আনন্দের জন্যই যেতেন না। সেখানে দেখা দিত সামাজিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কে কত বেশি অর্থ ছড়াতে পারেন, কে সবচেয়ে দামি গয়না উপহার দিতে পারেন, তা-ই ছিল গৌরবের বিষয়। একজন বাবু যদি এক রাতের আসরে এক হাজার টাকা ছড়ান, পরদিন আরেকজন বাবু তার দ্বিগুণ খরচ করে নাম কুড়িয়ে নিতেন। এভাবে নাচঘরগুলো পরিণত হয়েছিল ধনীদের অহংকার প্রদর্শনের মঞ্চে।
বিখ্যাত কিছু নর্তকীর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল শহরময়। তাদের আসরে বাবুরা প্রতিযোগিতা করে হাজির হতেন। অনেকে আবার তাদের কাছে জায়গা করে নিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিতেন। একেকজন নর্তকীকে নিয়ে কাহিনি ছড়াত, কে তার প্রতি কতটা অর্থ ব্যয় করেছেন। এমনকি বাবুরা কখনো কখনো নিজেদের গৃহস্থালি তছনছ করে ফেলতেন কেবলমাত্র এসব নর্তকীর পেছনে টাকা খরচ করার জন্য।
নাচঘরের এই বিলাসিতা কেবল গান আর নাচেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। অনেক সময় আসরে পরিবেশন হতো দামী পানীয়, বিদেশি মদ আর বাহারি খাদ্যসামগ্রী। অতিথিদের সামনে সাজানো হতো রুপো ও সোনার থালা। যেন সবকিছুতেই ছিল টাকার উড়নচণ্ডী ব্যবহার। আসর যত জমকালো, বাবুর সম্মান তত উঁচু হতো সমাজে।
কিন্তু এই উন্মত্ত অপচয়ের ফলও ছিল ভয়াবহ। অনেক বাবুর পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল কেবল নাচঘরে অযথা টাকা উড়িয়ে। জমিদারির আয় বা ব্যবসার লাভ একসময় শেষ হয়ে যায়, কিন্তু খরচের দাপট কমেনি। ফলে অঢেল ধনসম্পদের বাবু পরিবারগুলো ধীরে ধীরে আর্থিক সংকটে পড়ে যায়। আজ কলকাতার ইতিহাসে এই নাচঘরগুলোর নাম শোনা যায়, কিন্তু সেসব বাবুর উড়নচণ্ডী জীবনের গল্প ইতিহাসে এক সতর্ক বার্তা হিসেবেই বেঁচে আছে।
নাচঘর তাই কেবল একটি বিনোদনের জায়গা ছিল না, বরং সেটি হয়ে উঠেছিল বাবু সংস্কৃতির সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রতীক। যেখানে টাকা উড়ানো মানেই ছিল আভিজাত্য, আর অপচয় মানেই ছিল সম্মান। তবে সেই সম্মান দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। টাকার বৃষ্টি একসময় থেমে গেছে, রয়ে গেছে কেবল পতনের কাহিনি আর স্মৃতিচিহ্ন।