বাবু কালচার
কৃষ্ণা বসু, কলকাতা: কলকাতার বাবুদের ইতিহাস যতটা জাঁকজমকপূর্ণ, ততটাই বেদনাদায়ক। একসময় শহরের রাস্তাঘাটে, আসর-আড্ডায় আর রাজকীয় বাড়িঘরে তারা ছিলেন আভিজাত্যের প্রতীক। কিন্তু তাদের সেই ঐশ্বর্যের উজ্জ্বল আলো বেশিদিন জ্বলতে পারেনি। বেহিসেবি খরচ, টাকা উড়ানোর উন্মত্ত প্রতিযোগিতা এবং অপচয়ের সংস্কৃতি শেষ পর্যন্ত অনেক বাবুর পরিবারকে নিঃস্ব করে দিয়েছিল। আজ সেই বাবুদের গল্প শুধু ইতিহাসের বইয়ে নয়, ভগ্নপ্রায় দালানকোঠা আর ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদের ভেতরেও প্রতিধ্বনিত হয়।
১৮শ শতকের শেষভাগ থেকে ১৯শ শতক পর্যন্ত কলকাতার বাবুরা এক অভিজাত শ্রেণির উত্থান ঘটান। জমিদারি আর ব্যবসার বিপুল অর্থ তারা ব্যয় করতেন মূলত বিলাসিতায়। সোনার হুঁকো, রুপোর পালকি, বিদেশি আসবাব, ইউরোপীয় পোশাক, নাচঘরের আসর—সবখানেই তারা প্রতিযোগিতা করে টাকা উড়াতেন। কিন্তু আভিজাত্যের এই প্রদর্শনীতে তারা প্রায়শই ভুলে যেতেন অর্থের প্রকৃত মূল্য। সমাজে মর্যাদা আর সম্মান পাওয়ার জন্য যে ধনসম্পদ তারা উড়াতেন, সেটাই একদিন হয়ে উঠেছিল তাদের পতনের প্রধান কারণ।
বাবুদের পরিবারে আর্থিক স্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। জমিদারি থেকে আসা আয়ের ওপর তারা অতিরিক্ত নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু জমিদারি ব্যবস্থা ভেঙে গেলে, ভূমি সংস্কার আইন চালু হলে কিংবা ব্যবসায় ক্ষতি হলে বাবুদের বিপুল ব্যয়ের ভার আর টিকত না। যে বাবু এক রাতে নাচঘরে সোনার গয়না ছড়িয়ে দিতেন, তারই উত্তরসূরি একসময় সংসার চালাতে হিমশিম খেতেন। অনেকে তাদের বাড়িঘর বন্ধক রেখে দেন, আবার কারো বাড়ি নিলামে বিক্রি হয়ে যায়।
আজ কলকাতার বহু জায়গায় এখনও বাবু সংস্কৃতির ছাপ দেখা যায়। উত্তর কলকাতার পুরোনো দালানকোঠা, শোভাবাজারের রাজবাড়ি কিংবা শ্যামবাজারের কিছু পুরোনো প্রাসাদ সেই অতীতের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঝাড়বাতি, ভগ্ন সিঁড়ি, ভাঙা বারান্দা যেন বলে দেয় একসময়ের ঐশ্বর্য আজ কেবল ইতিহাস। সেই বাবুদের বংশধরদের অনেকেই সাধারণ জীবনযাপনে নেমে আসতে বাধ্য হন।
এই কাহিনি থেকে বর্তমান প্রজন্মের জন্য শিক্ষা রয়েছে। আভিজাত্য দেখাতে গিয়ে বেহিসেবি অপচয় সাময়িক গৌরব আনতে পারে, কিন্তু তা স্থায়ী সুখ দেয় না। অর্থকে যদি কেবল প্রদর্শনের মাধ্যম বানানো হয় তবে তার শেষ হয় নিঃস্বতায়। বাবুদের পতনের গল্প আজও প্রমাণ করে যে টাকার প্রকৃত মূল্য বুঝে ব্যয় করাই টেকসই সমৃদ্ধির একমাত্র উপায়।
কলকাতার বাবুদের ইতিহাস তাই কেবল বিনোদনের রঙিন কাহিনি নয়, বরং এক সতর্কবার্তাও বটে। যাদের হাতে অঢেল সম্পদ ছিল, তারা যদি অপচয়ের দাসে পরিণত হয়ে পতনের পথে চলে যান, তবে আজকের সমাজও সেই একই ভুল করলে ভিন্ন কোনো পরিণতি পাবে না। বাবু সংস্কৃতি আজ হারিয়ে গেছে, তবে তার ভগ্নপ্রায় নিদর্শনগুলো যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয় টাকার অপচয়ের বিপদ আর সংযমের গুরুত্ব।