বিজেনসটুডে২৪ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্র এখন যেন ধুলো আর বিষাক্ত কণার বন্দি শহর। বিশেষ করে বন্দর এলাকা ও পাহাড়তলীতে বায়ুদূষণের মাত্রা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। প্রতিদিন হাজারো ট্রাক ও কন্টেইনারবাহী যানবাহনের চলাচল, নির্মাণকাজের ধুলা, এবং কয়লাভিত্তিক কার্যক্রমের ফলে এই অঞ্চল দুটি পরিণত হয়েছে দূষণের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়।
বন্দরের চারপাশে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজারের বেশি কন্টেইনারবাহী ট্রাক চলাচল করে। এসব যানবাহনের অধিকাংশই পুরোনো ও ধোঁয়াযুক্ত। ডিজেল চালিত ইঞ্জিন থেকে বের হওয়া কালো ধোঁয়া বাতাসে ছড়িয়ে দেয় ক্ষুদ্র কণা, যা ফুসফুসে প্রবেশ করে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। এ ছাড়া বন্দর এলাকায় যে কয়লা ও লোহা-ইস্পাত পরিবহন হয়, তা খোলা অবস্থায় বহন করায় বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে ক্ষতিকর ধুলা ও ধাতব কণা।
পাহাড়তলী এলাকা, যেখানে একাধিক ওয়ার্কশপ, কারখানা ও গুদাম রয়েছে, সেখানেও প্রতিদিনের কর্মযজ্ঞের কারণে বাতাস ভারী হয়ে থাকে। অগোছালোভাবে পরিচালিত ইস্পাত মিল, ওয়ার্কশপ ও প্লাস্টিক প্রক্রিয়াকরণ কারখানাগুলো থেকে নির্গত ধোঁয়া ও ধাতব গুঁড়ো বাতাসে মিশে শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ভোর হতেই বাতাস ভারী হয়ে আসে। ঘরবাড়ির জানালা খুললেই ধুলায় সবকিছু ঢেকে যায়। শিশু ও বৃদ্ধরা বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। সিটি করপোরেশন নিয়মিত পানি ছিটিয়ে ধুলো কমানোর চেষ্টা করলেও তা পর্যাপ্ত নয়। বিশেষ করে পোর্ট কানেক্টিং রোড ও পাহাড়তলী বাজার এলাকায় ধুলোর ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি ও ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। এর পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে শহরের বায়ুদূষণকে দায়ী করছেন তারা। বিশেষ করে যারা এসব শিল্প এলাকায় কাজ করেন, তাদের ফুসফুসের অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে।
বায়ু মান সূচক বা একিউআই অনুযায়ী, এই অঞ্চলের স্কোর প্রায়শই ২০০ ছাড়িয়ে যায়, যা আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর’। অথচ এখানে বায়ুমান পরিমাপ বা সতর্ক সংকেত প্রদর্শনের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই।
বন্দর এলাকার ছোট ব্যবসায়ী মনজুর হোসেন বলেন, “আমাদের দোকানের সামনে প্রতিদিন প্রচুর যানবাহন চলাচল করে। ট্রাক ও ভারী যানবাহনের ধুলায় আমাদের পণ্যের ওপর কালো ময়লা জমে যায়। হাতে পায়ে জ্বালা হয়, বিশেষ করে বিকেলে ধুলার মাত্রা বেশি থাকে। প্রশাসন যেন ট্রাক চলাচলের সময় সীমাবদ্ধ করে।”
পাহাড়তলীর বাসিন্দা এবং একজন স্কুল শিক্ষক ফারহানা আক্তার জানালেন, “আমার স্কুলের আশেপাশে রাস্তার ধুলো খুবই বেশি। অনেক ছাত্রছাত্রী শ্বাসকষ্টে ভোগে। বিশেষ করে শীতে বাতাসের মান খারাপ হয়। অভিভাবক এবং শিক্ষকরা সবাই মিলে সচেতন হওয়া দরকার।”
চাকরিজীবী রুবেল আহমেদ বলেন, “দফতরে থাকলে মাস্ক পরে থাকি, কিন্তু বাইরে বেরুলেই ধুলো আর কালো ধোঁয়ায় ফুসফুসে সমস্যা হয়। গাড়ি কমানো, শিল্প থেকে নির্গত দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা না হলে এই সমস্যা কমবে না।”
এক বৃদ্ধা বেগম খালেদা বলেন, “আমরা অনেক বছর থেকে এখানে থাকি। আগে বাতাস কিছুটা পরিষ্কার ছিল। এখন দিনের পর দিন বাতাস খারাপ হচ্ছে। তরুণরা সচেতন হলেও আমরা বয়স্করা পারি না অনেক কিছু করার। সবাইকে একসঙ্গে এগোতে হবে।”
পরিবেশ কর্মী ইমরান হাসান বলেন, “সরকারি নিয়ম থাকলেও বন্দর এলাকায় কয়লা পরিবহন ও পুড়ানো এখনও সীমাহীন। এতে বায়ুদূষণ অনেক বেড়ে যায়। প্রশাসনকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, কারণ মানুষের স্বাস্থ্য সবচেয়ে বড় সম্পদ।”
বায়ুদূষণ শুধু শ্বাসকষ্ট নয়, হৃদরোগ ও ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার কারণও হয়ে দাঁড়াচ্ছে। স্থানীয়দের উদ্বেগ যেমন বাড়ছে, তেমনি দ্রুত সমাধানের জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ সংস্থাগুলোর যৌথ উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তাও বেড়েই চলেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেইনার পরিচালনা পদ্ধতিতে আধুনিকায়ন, কয়লা পরিবহন বন্ধ, এবং খোলা ট্রাক নিয়ন্ত্রণ না করা পর্যন্ত এই অঞ্চলের পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়। একইভাবে পাহাড়তলী এলাকায় কারখানাগুলোর নির্গমন নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে এবং নিয়মিত পরিবেশ তদারকি চালাতে হবে।
চট্টগ্রাম শহর শিল্প ও বাণিজ্যের কেন্দ্র হলেও, এর বায়ু প্রতিনিয়ত বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে আগামী প্রজন্মের জন্য এই অঞ্চল বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।