Home Third Lead “আমার পালা কবে?” -নাটোরে বাল্যবিয়ের ভয়ে কাঁপছে স্কুলের মেয়েরা

“আমার পালা কবে?” -নাটোরে বাল্যবিয়ের ভয়ে কাঁপছে স্কুলের মেয়েরা

 

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, নাটোর: নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার ধানুড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে শুনশান নীরবতা। বান্ধবীদের একজন নেই, আরেকজন ‘বিয়ের ঘরে’। প্রতি সপ্তাহে এক-দুজন করে মেয়েশিশু বিয়ের পিঁড়িতে বসে চলে যাচ্ছে পাঠশালার গণ্ডি ছেড়ে অজানা ভবিষ্যতের দিকে।

জান্নাতুল ফেরদৌস, দশম শ্রেণির ছাত্রী। চোখে স্বপ্ন ছিল শিক্ষিকা হওয়ার। কিন্তু এখন তার চোখে আতঙ্ক। গত মাসেই তার তিন বান্ধবীর বিয়ে হয়েছে। ক্লাসে প্রতিদিন কাউকে না কাউকে হারাতে হচ্ছে। তার প্রশ্ন, “আমার পালা কবে আসবে?”

 ধানুড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে বাল্যবিয়ে এখন এক নীরব মহামারিতে রূপ নিয়েছে। বিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ১০৬ জন ছাত্রী শুধুমাত্র বিয়ের কারণে স্কুল ত্যাগ করেছে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত টিকতে পারেনি ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া প্রায় ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী।  যাদের মধ্যে অনেকে এসএসসি পরীক্ষার আগেই সংসার জীবনে পা রেখেছে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আলমগীর বলেন, “আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। এলাকায় শিক্ষক নিযুক্ত করেছি, যাতায়াতের জন্য বাসের ব্যবস্থা করেছি, সচেতনতা সভা করছি। কিন্তু তাতেও অভিভাবকদের মানসিকতা বদলাচ্ছে না। অষ্টম শ্রেণি মানেই যেন বিয়ের বয়স।”

বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস কাঁপা গলায় বলেন, “প্রতি সপ্তাহেই কেউ না কেউ বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। আমার খুব ভয় লাগে, কখন যেন আমার নামটা উঠে যায়। কেউ ক্লাসে আসছে না, তারা সংসার করছে।”

বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা আসে মূলত চাপিলা ইউনিয়নের ধানুড়া, চন্দ্রপুর, শ্যামপুর, পুঠিমারী ও ওয়াপদাবাজার এলাকা থেকে। পরিবারগুলোর বেশিরভাগই দিনমজুর কিংবা ক্ষুদ্র কৃষক। দারিদ্র্য, কুসংস্কার, এবং কন্যাশিশুকে বোঝা হিসেবে দেখার সংস্কৃতি—সব মিলিয়ে তাদের স্কুল থেকে বিচ্যুত হওয়া যেন পূর্বনির্ধারিত।

শুধু তা-ই নয়, বিদ্যালয়ে ‘মিড ডে মিল’ কর্মসূচিও ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে অর্থ সংকটে বন্ধ হয়ে যায়, যা ছিল শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়ানোর একটি কার্যকর উদ্যোগ। এখন পেট খালি, ব্যাগ খালি, ক্লাসরুমও খালি।

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহমিদা আফরোজ বলেন, “পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। মিড ডে মিল পুনরায় চালু করতে আমরা কাজ করছি। শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরিয়ে আনতে আরও পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”

শিশু অধিকার রক্ষা নিয়ে কাজ করা সংস্থা ‘অধিকার পরামর্শ কেন্দ্র’-এর এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ধানুড়া অঞ্চলে প্রতি ১০ জন কিশোরীর মধ্যে ৬ জন ১৬ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যায়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিষয়টি শুধু আর্থিক সমস্যা নয়, সামাজিক সচেতনতারও ঘাটতি। যদি এই বাল্যবিয়ের চক্র ভাঙা না যায়, তবে আগামী এক দশকে এই অঞ্চলে মাধ্যমিক শিক্ষায় কন্যাশিক্ষার হার ভয়াবহভাবে নিচে নেমে আসবে।