গড়ে উঠছে এক অন্যরকম মায়ার জগত
তারিক-উল-ইসলাম, ঢাকা: সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে ঘরে ফিরতেই দরজার সামনে অপেক্ষায় থাকে একজোড়া মায়াবী চোখ। নরম তুলতুলে শরীর নিয়ে পায়ে গা ঘষতে ঘষতে আদুরে গলায় ‘মিউ’ শব্দ, নিমিষেই যেন উধাও হয়ে যায় সব ক্লান্তি। বলছিলাম বিড়াল এবং তাদের মানুষের (যাদের এখন বলা হয় ‘ক্যাট প্যারেন্ট’) এক অদ্ভুত ভালোবাসার কথা। একসময় গ্রামবাংলায় বিড়াল পোষা হতো মূলত ইঁদুরের উৎপাত থেকে বাঁচতে, কিন্তু এখন সেই চিত্র বদলেছে। বিড়াল এখন আর ‘গৃহপালিত প্রাণী’ মাত্র নয়, বরং পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্য বা ‘ফার বেবি’ ।
একাকিত্বের সঙ্গী ও মানসিক প্রশান্তি
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, যান্ত্রিক শহরের চারদেয়ালে বন্দি মানুষের একাকিত্ব কাটাতে বিড়ালের জুড়ি নেই। বিড়ালের গলার ‘পার’ বা ঘরঘড় শব্দ মানুষের রক্তচাপ কমাতে এবং মানসিক চাপ দূর করতে সাহায্য করে।
ঢাকার ধানমন্ডির বাসিন্দা ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সাবিহা বলেন, “পড়াশোনার চাপে যখন খুব ডিপ্রেশনে থাকতাম, তখন ‘টুনি’ (তার বিড়াল) আমার জীবনে আসে। ও আমার কোনো কথা বোঝে না ঠিকই, কিন্তু ওর দিকে তাকিয়ে থাকলেই মন ভালো হয়ে যায়। ও আমার কাছে শুধু বিড়াল নয়, আমার থেরাপিস্ট।”
‘ক্যাট প্যারেন্টিং’ এবং অনলাইন কমিউনিটি
বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে ফেসবুকভিত্তিক বিড়াল প্রেমীদের বিশাল কমিউনিটি গড়ে উঠেছে। ‘ক্যাট লাভারস অফ বাংলাদেশ’ বা এই জাতীয় গ্রুপগুলোতে লক্ষাধিক সদস্য রয়েছেন। সেখানে বিড়ালের ছবি শেয়ার করা থেকে শুরু করে অসুস্থ বিড়ালের চিকিৎসার পরামর্শ—সবই চলে।
এই কমিউনিটির সদস্যরা নিজেদের ‘মালিক’ না বলে ‘বাবা’ বা ‘মা’ পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বিড়ালের জন্মদিন পালন, তাদের জন্য বিশেষ কেক কাটা, এমনকি ঈদের সময় তাদের জন্য নতুন জামা কেনার চলও এখন স্বাভাবিক ঘটনা।
দেশি বনাম বিদেশি: দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন
একটা সময় ছিল যখন শৌখিন মানুষ কেবল পারশিয়ান বা বিদেশি জাতের লোমশ বিড়ালের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু এখন সেই ধারায় বড় পরিবর্তন এসেছে। রাস্তার অবহেলিত দেশি বিড়ালকে উদ্ধার করে পরম যত্নে ঘরে ঠাঁই দিচ্ছেন হাজারো তরুণ-তরুণী।受伤 বা এতিম বিড়াল ছানাকে বোতলে দুধ খাইয়ে বড় করে তোলার গল্প এখন অহরহ। একে বলা হচ্ছে ‘অ্যাডপশন কালচার’। টাকা দিয়ে প্রাণী না কিনে, রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নেওয়া এই বিড়ালগুলোই হয়ে উঠছে তাদের চোখের মনি।
খরচ এবং চ্যালেঞ্জ
বিড়াল প্রেমীদের এই পথচলা সবসময় মসৃণ নয়। রাজধানীতে ভাড়া বাসায় বিড়াল রাখতে না দেওয়া বা ‘নো পেট পলিসি’ বিড়াল প্রেমীদের জন্য সবচেয়ে বড় সংকট। এছাড়া ভালো মানের ক্যাট ফুড (খাবার), লিটার (পায়খানা করার বালু), এবং ভ্যাকসিনের খরচও কম নয়।
মিরপুরের বাসিন্দা রাশেদ জানান, “নিজের খাবারের চেয়ে আমার বিড়ালের খাবারের চিন্তা আগে করতে হয়। মাসের শুরুতেই তাদের জন্য বাজেটের একটা বড় অংশ বরাদ্দ থাকে। আর হঠাৎ অসুস্থ হলে ভালো ভেট (পশু চিকিৎসক) খুঁজে পাওয়া এবং চিকিৎসার খরচ বহন করা বেশ চ্যালেঞ্জিং।”
বিড়ালের বাজার অর্থনীতি
বিড়াল প্রেমীদের এই আবেগকে কেন্দ্র করে দেশে গড়ে উঠেছে এক বিশাল বাজার। সুপারশপগুলোতে এখন মানুষের খাবারের পাশাপাশি বিড়ালের খাবারের আলাদা তাক থাকে। অনলাইনে গড়ে উঠেছে অসংখ্য পেট শপ। বিড়ালের খেলনা, বিছানা, নখ কাটার যন্ত্র, শ্যাম্পু থেকে শুরু করে বহন করার ব্যাগ—কী নেই সেই তালিকায়!
ভালোবাসার কোনো ভাষা নেই
অনেকে প্রশ্ন তোলেন, মানুষের এত অভাবের মাঝে প্রাণীর পেছনে এত খরচ কেন? বিড়াল প্রেমীদের কাছে এর উত্তর খুব সহজ—ভালোবাসা। যে প্রাণীটি নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসা দেয়, যার কোনো ছলচাতুরী নেই, তার প্রতি মানুষের এই মায়া চিরন্তন।
এই চারপেয়ে সন্তানরা হয়তো কথা বলতে পারে না, কিন্তু তাদের মায়াবী চোখের ভাষায় যে নির্ভরতা থাকে, তাতেই বাঁধা পড়ে আছেন লক্ষ লক্ষ বিড়াল প্রেমী। ইট-পাথরের এই রুক্ষ শহরে বিড়ালগুলো যেন এক পশলা নরম বৃষ্টির মতো।










