Home First Lead চট্টগ্রামে বিষাক্ত ট্যাংকার, ইউরোপে তদন্তের দাবি

চট্টগ্রামে বিষাক্ত ট্যাংকার, ইউরোপে তদন্তের দাবি

ইউরোপের বিষাক্ত জাহাজবাণিজ্য: যেভাবে মারিনাকিসের ট্যাংকার ট্রেডার থ্রি অবৈধ পথে সৈকতায়ন 
বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: ইউরোপের প্রভাবশালী জাহাজমালিকরা এখনো পুরোনো ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর জাহাজগুলোকে দক্ষিণ এশিয়ার ঝুঁকিপূর্ণ জাহাজভাঙা ইয়ার্ডে পাঠিয়ে চলেছে। সম্প্রতি অনুসন্ধানী সংস্থা রিপোর্টার্স ইউনাইটেড গ্রিক জাহাজমালিক ভ্যাঙ্গেলিস মারিনাকিসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি কোম্পানির ট্যাংকার ট্রেডার থ্রি (TRADER III) অবৈধভাবে বাংলাদেশে ভেড়ানোর ঘটনা উন্মোচন করেছে। এটি কেবল একটি লেনদেন নয়, বরং ইউরোপের এক শ্রেণির জাহাজমালিকের পরিবেশ ও শ্রম নিরাপত্তার প্রতি চরম উদাসীনতার এক জলজ্যান্ত প্রমাণ। এই ঘটনা আবারও প্রশ্ন তুলেছে আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ভূমিকা নিয়ে।

ট্রেডার থ্রি -এর গোপন যাত্রা:
রিপোর্ট অনুযায়ী, ট্রেডার থ্রি ট্যাংকারটি ২০২৫ সালের ২৯ জানুয়ারি তুরস্কের নেমরুত বন্দরে নোঙর করে। এরপর এটি গ্রিসের উপকূল হয়ে মিসরের কাছে অবস্থান নেয় এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। অবশেষে ১৫ মার্চ এটি চট্টগ্রামের কিং স্টিল ইয়ার্ডে (কেআর শিপ রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ) ভেড়ানো হয়। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের কঠোর নজরদারি এড়িয়ে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল জাহাজটিকে এমন একটি দেশে পাঠানো, যেখানে পরিবেশ বা শ্রম নিরাপত্তার কোনো মানদণ্ড কার্যকর নয়।

জিএমএস এর ভূমিকা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের লাভ:
এই অবৈধ বেচাকেনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল গ্লোবাল মার্কেটিং সিস্টেমস, বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্ক্র্যাপ জাহাজ ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন ধরে এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পরিবেশবিধ্বংসী জাহাজভাঙা বাণিজ্যকে উৎসাহ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। রিপোর্টার্স ইউনাইটেডের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মারিনাকিসের সংশ্লিষ্ট কোম্পানি সরাসরি জাহাজটি জিএমএস -এর কাছে বিক্রি করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার বিচিং ইয়ার্ডগুলোতে স্ক্র্যাপের দাম বেশি এবং নিয়মকানুনও শিথিল। এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীরা বিপুল লাভ করে থাকে।

গ্রিসের ‘ইচ্ছাকৃত নিষ্ক্রিয়তা’ এবং ইইউর অবমাননা:
রিপোটার্স ইউনাইটেড আরও জানায়, জাহাজমালিক ও জিএমএস আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে কীভাবে এসব জাহাজ দক্ষিণ এশিয়ার সৈকতে পাঠায়, সেটিও স্পষ্ট হয়েছে। ২০২৫ সালের জুনে জিএমএস  আয়োজিত এক অনলাইন অনুষ্ঠানে গ্রিসের পরিবেশ বিষয়ক মহাসচিব পেট্রোস ভারেলিডিস প্রকাশ্যে বলেন যে, এ ধরনের ‘এন্ড-অব-লাইফ’ জাহাজ রপ্তানির ক্ষেত্রে গ্রিক সরকার “ইচ্ছাকৃতভাবে নিষ্ক্রিয়” নীতি অনুসরণ করছে। এমনকি তিনি ইইউর জাহাজ পুনর্ব্যবহার বিষয়ক কর্মকর্তাদের “নিম্নস্তরের আমলা” বলেও অবমাননা করেন। এটি ইইউর আইনের প্রতি গ্রিক কর্তৃপক্ষের স্পষ্ট অবজ্ঞা প্রকাশ করে।

বাংলাদেশের শ্রমিকদের ঝুঁকি ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন:
গ্রিক কর্তৃপক্ষের এই নিষ্ক্রিয়তার ফল ভোগ করছে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার শ্রমিকরা। চট্টগ্রামের জাহাজভাঙা ঘাট এখনো বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ কর্মস্থল। কিং স্টিল ইয়ার্ডেই গত আগস্টে দুর্ঘটনা ঘটে, যখন ট্রেডার থ্রি সেখানে ভেড়ানো ছিল। ইউরোপীয় আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে—ইইউভুক্ত দেশ থেকে ওইসিডি (OECD) বহির্ভূত দেশে পুরোনো জাহাজ রপ্তানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এছাড়া ইইউ শিপ রিসাইক্লিং রেগুলেশন অনুযায়ী কেবল অনুমোদিত ইয়ার্ডেই জাহাজ ভাঙা যাবে, যার তালিকায় বাংলাদেশের কোনো ইয়ার্ড নেই। কিন্তু মালিকরা প্রায়ই ভুয়া নিবন্ধন (‘ফ্ল্যাগ অব কনভিনিয়েন্স’) বা মধ্যস্বত্বভোগী বিক্রয়ের মাধ্যমে এসব আইন পাশ কাটিয়ে যায়। ইউরোপের কয়েকটি আদালত ইতোমধ্যে এমন চুক্তিকে বেআইনি ঘোষণা করে জাহাজমালিকদের দায় স্বীকার করাতে শুরু করেছে।

গ্রিস ও তুরস্ক: অবৈধ রপ্তানির ‘চোকপয়েন্ট’:
অনুসন্ধানে আরও বলা হয়েছে, গ্রিস ও তুরস্কই অবৈধ জাহাজ রপ্তানির প্রধান রুট বা ‘চোকপয়েন্ট’। এখান থেকেই এসব জাহাজ দক্ষিণ এশিয়ার বিচিং ইয়ার্ডের পথে রওনা হয়। অথচ, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বারবার সতর্ক করলেও দুই দেশই বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে।

শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম -এর আহ্বান:
এ বিষয়ে পরিবেশ সংগঠন শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম -এর নির্বাহী পরিচালক ইঙ্গভিল্ড ইয়েনসেন বলেন, “এখন দেখা যাবে, শক্তিশালী মালিকদের ক্ষেত্রেও আইন সমানভাবে কার্যকর হয় কি না। আমরা গ্রিক প্রসিকিউটরদের আহ্বান জানাই: তারা ট্রেডার থ্রি –এর বিক্রয়চুক্তি, ইমেইল ও সম্পূর্ণ সময়রেখা তদন্ত করে দেখুন। গ্রিক কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্ব পালন করেছে কি না, সেটিও যাচাই করা জরুরি। জাহাজটি যখন গ্রিস ছেড়েছিল, তখনই এর গন্তব্য অবৈধ হবে তা স্পষ্ট ছিল। ইইউকেও গ্রিসের এই ব্যর্থতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।”


ট্রেডার থ্রি-এর ঘটনা আবারও প্রমাণ করল, ইউরোপের শিপিং শিল্প এখনো পরিবেশ ও মানবজীবনের ক্ষতির বিনিময়ে মুনাফার পথেই হাঁটছে। এর ফল ভোগ করছে বাংলাদেশের মতো দেশের উপকূলীয় পরিবেশ ও বিপন্ন শ্রমজীবী মানুষ। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উচিত এই বিষয়ে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে তার সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কার্যকলাপের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য করা। এই অবৈধ বাণিজ্য বন্ধে সম্মিলিত বৈশ্বিক প্রচেষ্টা এখন সময়ের দাবি।