তারিক-উল-ইসলাম, ঢাকা: বাংলাদেশের কৃষিজমিতে সবুজের বিস্তার যতটা আশার কথা, তার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক অদৃশ্য ঝুঁকি। গত তিন দশকে দেশে ফসল উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ, কিন্তু সেই বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে রাসায়নিক নির্ভরতা। বিশেষ করে কীটনাশক ব্যবহারের হার এমনভাবে বাড়ানো হয়েছে যে, আজ গ্রামীণ কৃষিজমি থেকে শুরু করে খাদ্যচক্র পর্যন্ত বিষের ছায়া ক্রমেই ঘন হচ্ছে।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উচ্চফলনশীল বীজ ও নিবিড় চাষাবাদের যে চাপ তৈরি হয়েছে, তা কৃষকদেরকে সহজ সমাধানের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বাজারে সহজলভ্য কীটনাশক দ্রুত ফল দেখালেও দীর্ঘমেয়াদে এর ক্ষতি বহুস্তর। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে অনুমোদিত রাসায়নিকের পাশাপাশি অননুমোদিত, নকল ও অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যবহার করা হচ্ছে এমন সব কীটনাশক যা মাটি, পানি ও মানবদেহে সরাসরি ক্ষতি ডেকে আনে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, অনেক কৃষক এখনও পোকা দমনের সঠিক পদ্ধতি জানেন না। পোকামাকড় দেখা দিলেই তারা দোকানে ছুটে যান। দোকানদারের পরামর্শেই হাতে তুলে নেন শক্তিশালী রাসায়নিক। ফলে কখন, কোন ফসলের জন্য, কত ঘনমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে, এসব মৌলিক নিয়ম অজ্ঞাতই থেকে যায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাজারে বালাইনাশক কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী বিপণন। কৃষকের লাভের আশাকে পুঁজি করে তারা সহজে প্রভাব বিস্তার করতে পারছে।
মাঠপর্যায়ের বাস্তব চিত্র আরও উদ্বেগজনক। অনেক এলাকায় এখনও বিষ প্রয়োগের সময় কৃষকেরা ন্যূনতম সুরক্ষা উপকরণ ব্যবহার করেন না। মাস্ক বা গ্লাভসের অভাব তো আছেই, অনেক সময় বাতাসের বিপরীত দিকে দাঁড়িয়েও স্প্রে করা হয়। এতে বিষাক্ত রাসায়নিক সরাসরি শ্বাসতন্ত্রে প্রবেশ করে। কৃষকেরা তাৎক্ষণিক কোনো সমস্যা অনুভব না করলেও দীর্ঘমেয়াদে এসব রাসায়নিক রক্ত, যকৃত ও স্নায়ুতন্ত্রে গুরুতর প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের কিছু গবেষণার ফল অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মাটিতে ধীরে ধীরে জমছে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ। অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে মাটির জৈব উপাদান কমে যাচ্ছে, নিধন হচ্ছে উপকারী পোকামাকড়। এতে পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও কমে যায়, ফলে কৃষক আরও বেশি বিষ ব্যবহার করতে বাধ্য হন। এভাবে তৈরি হচ্ছে যেন এক দুষ্টচক্র।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কীটনাশক ব্যবহারের বর্তমান প্রবণতা যদি আরও কয়েক বছর অব্যাহত থাকে, তবে কৃষিজমির স্বাস্থ্য ফিরে পাওয়া কঠিন হবে। মাটি উর্বরতা কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদনও হুমকির মুখে পড়বে। আর সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে জনস্বাস্থ্যের, ফসলের সঙ্গে খাদ্যচক্রে প্রবেশ করা বিষ দীর্ঘমেয়াদে রোগব্যাধির ঝুঁকি বাড়াবে।
এখন সময় এসেছে কৃষিতে টেকসই পদ্ধতি গ্রহণের। কৃষকের কাছে সচেতনতা পৌঁছে দেওয়া, সঠিক প্রশিক্ষণ, বাজারে নকল ও অতিরিক্ত ক্ষতিকর রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ, পরীক্ষাগার সক্ষমতা বৃদ্ধি—এসব না হলে বিষের ছায়া আরও বিস্তার লাভ করবে।
এই সিরিজের পরবর্তী পর্বে থাকছে
মাঠ থেকে থালা পর্যন্ত: ফসলের সঙ্গে কীহারে যাচ্ছে ক্ষতিকর অবশিষ্টাংশ










