এভিয়েশন ডেস্ক: ২০০৩ সালের এক ঘন বিকেল। আফ্রিকার আকাশে তখন ধুলোমাখা সূর্যের বিদায়বেলা। অ্যাঙ্গোলার লুয়ান্ডা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্বাভাবিক কর্মচাঞ্চল্যে দিন গুজরান করছিল। হঠাৎই আকাশ কাঁপিয়ে উঠল এক বোয়িং ৭২৭ বিমানের গর্জন। রেজিস্ট্রেশন নম্বর N844AA। সেটি বহুদিন ধরে বিমানবন্দরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে ছিল—মনে হতো, যেন আকাশ ভুলে যাওয়া এক প্রাক্তন পাখি। কিন্তু সেদিন, কেউ যেন সেই মৃত পাখির প্রাণ ফিরিয়ে দিল।
বিমানটি গর্জাতে গর্জাতে রানওয়েতে চলে এলো। কেউ অনুমতি দেয়নি, কোনও কন্ট্রোল টাওয়ারে কোনও বার্তা আসেনি, কোনো লাইট সিগন্যালও না। শুধু দেখা গেল, ককপিটে দুজন মানুষ—একজন সাদা চামড়ার, অন্যজন কৃষ্ণবর্ণ। বিমান চালানো শুরু করল তারা। মুহূর্তেই রানওয়ে ধরে দৌড়, তারপর ছোঁ মেরে আকাশে উড়ে গেল বিশালাকার যন্ত্রপাখিটি।
আর তারপর—পুরো নিখোঁজ।
কে ছিলেন তারা?
দুজন মানুষ সেই দিন বিমানে উঠেছিলেন। একজন আমেরিকান নাগরিক, নাম বেন চার্লস প্যাডিল্লা—পেশায় বিমান মেকানিক, পাইলটের লাইসেন্স ছিল। অন্যজন কঙ্গোর নাগরিক জন মুতানতু, তার সহকারী। তারা কেউই পেশাদার পাইলট ছিলেন না, বড় জোর ছোটখাটো উড়োজাহাজ চালাতে পারতেন। অথচ তারা সফলভাবে বিশাল এক ২০০-সিটের বিমান চালিয়ে তুলেছিলেন আকাশে।
তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল? কোথায় তারা যাচ্ছিলেন? আর তারা কি আদৌ নিজেরা পরিকল্পনার কেন্দ্রে ছিলেন, নাকি বড় কোনও রহস্যের মুখপাত্র?
তিনটি ঘণ্টা। তারপর নিস্তব্ধতা।
বিমানের শেষ সংকেত মিলেছিল উড়ার তিন ঘণ্টা পর। তারপর—নিরবতা। রাডার কিছুই ধরতে পারেনি। না ছিল ট্রান্সপন্ডার, না ছিল কোনও রেডিও বার্তা। বিমানটি যেন আফ্রিকার গহীন অরণ্য বা আটলান্টিক মহাসাগরের গোপন গহ্বরে গিলে নিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, অ্যাঙ্গোলা, ইন্টারপোল—সবাই মাঠে নামে। স্যাটেলাইট থেকে শুরু করে উপগ্রহচিত্র, সাগরের তলদেশ পর্যন্ত খুঁজে ফেলা হয়। কিন্তু কোনও ধ্বংসাবশেষ নেই, নেই কোনও তেল ছিটে থাকা দাগ। যেন পুরো বোয়িং ৭২৭ বিমানের অস্তিত্ব মুছে গেছে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে।
তত্ত্বের ছায়াপথে: কী হতে পারত?
১. চুরি ও কালোবাজার
হয়তো প্যাডিল্লা চেয়েছিলেন বিমানটি বিক্রি করতে। হয়তো কোনও গোপন ক্রেতার কাছে, মধ্যপ্রাচ্যের কোনও দেশে। এক বিমানের মূল্য কোটি কোটি টাকা। তবে এত বড় বিমানের জন্য তো রানওয়ে লাগে, ল্যান্ডিং লাগে, কাস্টমসের নজরদারি থাকে—তা সত্ত্বেও বিমানটি কোথায় নামল?
২. সন্ত্রাসবাদ?
২০০১-এর ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক। অনেকে ভয় পেয়েছিলেন, বিমানটি হয়তো ভবিষ্যৎ কোনও সন্ত্রাসী হামলার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু দুই দশক কেটে গেলেও এর কোনও প্রমাণ নেই, কোনও দাবি উঠল না।
৩. দুর্ঘটনা?
যদি বিমানটি দুর্ঘটনায় পড়ে থাকে, তবে ধ্বংসাবশেষ কোথায়? এত বিশাল বিমান, জ্বালানি ভর্তি, বিস্ফোরণ হলে তার ছিটেফোঁটা অন্তত সাগরে ভেসে থাকত। কিন্তু না—এক চিলতে অংশও খুঁজে পাওয়া গেল না।
৪. সরকারি ষড়যন্ত্র?
কেউ কেউ বিশ্বাস করে, বিমানটি কোনও গুপ্ত মিশনে নেওয়া হয়েছিল। হয়তো গুপ্তচর সংস্থা বা সামরিক অভিযানের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। এই থিওরির কোনও প্রমাণ নেই, তবে ইতিহাস বলে—অনেক সময় সত্যটা খুব চুপচাপ লুকিয়ে থাকে।
একটি প্রশ্ন, বহু রাতের নির্ঘুমতা
বিমানের পেছনে গল্প ছিল, মানুষের স্বপ্ন ছিল, যন্ত্রপাতি ছিল। আর আজ, শুধু রয়ে গেছে এক বিস্ময়—আকাশ কি কোনও কিছু গিলে ফেলতে পারে চিরতরে?
২০০৩ সালের ২৫ মে ছিল এমনই এক দিন, যখন পুরো পৃথিবী বুঝতে পারল—আধুনিকতার আলোয় ভরপুর এই পৃথিবীতেও অন্ধকারে হারিয়ে যেতে পারে এক বিশাল বিমান, দুজন মানুষ এবং এক রহস্য, যেটা হয়তো কোনওদিনও সমাধান হবে না।
“আপনিও কি বিশ্বাস করেন, এই বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল, নাকি এটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত অন্তর্ধান?
আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন।