Home ইতিহাস ও ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার পথে বোস্তামী কাছিম: কিংবদন্তি, সংকট ও সংরক্ষণের লড়াই

হারিয়ে যাওয়ার পথে বোস্তামী কাছিম: কিংবদন্তি, সংকট ও সংরক্ষণের লড়াই

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের প্রাচীন সুফি মাজার হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.)-এর পুকুরটি যেন ইতিহাসের এক জীবন্ত ফ্রেম। এখানে বয়ে চলেছে শতাব্দী পেরনো এক নিঃশব্দ জীবন — বোস্তামী কাছিম। পুকুরের থমথমে জলে ভেসে থাকা এই কাছিমদের ঘিরে গড়ে উঠেছে জনশ্রুতি, বিশ্বাস, এবং এখন শঙ্কা। তাদের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে, আর প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন হারিয়ে যাওয়া সময়ের সাক্ষী হয়ে থাকছে।

জনশ্রুতি অনুসারে, নবম শতাব্দীতে হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) চট্টগ্রামে আসেন। জনসাধারণের কল্যাণে তিনি অপশক্তিকে পরাজিত করে অভিশপ্ত করে কাছিমে রূপান্তরিত করেন। সেই অভিশপ্ত আত্মার ছায়ায় আজও এ পুকুরে বাস করছে বিশেষ ধরনের কাছিম, যাদের স্থানীয়ভাবে বলা হয় ‘বোস্তামী কাছিম’। মাজারের পুকুরে কাছিম হত্যা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, এবং অনেক ভক্ত তাদের ধর্মীয় পূণ্যকর্মের অংশ হিসেবে কাছিমদের খাবার দেয়। তবে আজ, এই কিংবদন্তির নীরব নায়কেরা প্রকৃত অস্তিত্বের জন্য লড়ছে।

বোস্তামী কাছিমের বৈজ্ঞানিক নাম Nilssonia nigricans। ২০০২ সালে আইইউসিএন এই প্রজাতিকে “বন্য পরিবেশে বিলুপ্ত” ঘোষণা করে। এই মুহূর্তে পৃথিবীতে তাদের স্বাভাবিক আবাস নেই। কেবলমাত্র মানুষের রক্ষিত পরিবেশ, বিশেষত বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও ভারতের আসামের সীমিত এলাকায় এরা টিকে আছে। গড় আয়ু প্রায় ৫০ বছর, তবে দূষিত জল ও খাদ্য সংকটের কারণে অনেক কাছিম সময়ের আগেই মৃত্যুবরণ করছে। এদের প্রধান খাদ্য হলো শামুক, জলজ উদ্ভিদ ও ছোট মাছ, কিন্তু বর্তমান দূষিত পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য প্রায় বিলুপ্ত।

মাজার কর্তৃপক্ষের হিসেবে, বর্তমানে প্রায় ৫৫০ থেকে ৬০০ বোস্তামী কাছিম এখানে বাস করছে। অথচ ১৯৮০-এর দশকে এই সংখ্যা ছিল হাজারের বেশি। এক সময়ে প্রজনন মৌসুমে পুকুরপাড়ের নরম মাটিতে অসংখ্য কাছিম উঠে এসে ডিম পাড়ত। এখন সেই দৃশ্য প্রায় অতীত। পর্যটকদের ভিড়, প্লাস্টিক বর্জ্য, অপরিষ্কার পানি, এবং পুকুরপাড়ের কঠিনকরণ এই কাছিমদের প্রজনন চক্রকে ভেঙে দিয়েছে। ডিম পাড়ার স্থানগুলো আজ মাটি ও পাথরের নীচে ঢাকা পড়েছে।

শুধু স্থানীয় নয়, আন্তর্জাতিক সংস্থারাও বোস্তামী কাছিম সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ প্রকল্পে প্রথমবারের মতো ইনকিউবেটরে ৫৩টি কাছিম ছানা জন্মানো হয়। এই ছানাদের একটি অংশ পুনরায় মাজারের পুকুরে ছাড়া হয়েছে। তবে গবেষকরা বলছেন, এত সামান্য সংখ্যক ছানা প্রকৃতির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে যথেষ্ট নয়। প্রকৃত সংরক্ষণে পানি বিশুদ্ধকরণ, নির্দিষ্ট প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি এবং নিয়ন্ত্রিত পর্যটন অপরিহার্য।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহফুজুর রহমান বলেন, “বোস্তামী কাছিম শুধু একটি প্রাণী নয়, এটি একটি ঐতিহ্য। আমরা যদি এখনই ব্যবস্থা না নিই, তাহলে আগামী বিশ বছরে এই কিংবদন্তি ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাবে।” তার মতে, নিয়মিত জল বিশুদ্ধকরণ, খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা এবং কাছিমদের জন্য নিরিবিলি আবাস নিশ্চিত করাই জরুরি।

আসামের কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যানে কাছিম সংরক্ষণের জন্য বিশেষ প্রকল্প চালু করা হয়েছে। সেখানে আলাদা নিরাপদ লেক তৈরি করে প্রজননের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলাদেশের বোস্তামী কাছিমদের ক্ষেত্রেও এমন উদ্যোগ প্রয়োজন। পুকুরের পানির জন্য ফিল্টার প্ল্যান্ট স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্থায়ী ফান্ড গঠন এবং পর্যটকদের জন্য পরিবেশ সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালু করা যেতে পারে। মাজার এলাকায় বায়োডিগ্রেডেবল খাবার প্যাকেট ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও তা পর্যাপ্তভাবে মানা হচ্ছে না, যা দূষণের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বোস্তামী কাছিম শুধু ধর্মীয় অনুভূতির প্রতীক নয়, এটি চট্টগ্রামের একটি সাংস্কৃতিক পরিচয়ও। এক বৃদ্ধ ভক্ত জানালেন, “আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি — কাছে এসে কাছিমের গায়ে জল ছুঁড়লে নাকি মনস্কামনা পূরণ হয়। এখন তো কাছিম পাওয়া দুষ্কর, শুধু ইচ্ছেই থেকে যায়।”

এদিকে পরিবেশবিদরা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে এই কাছিমদের ভবিষ্যৎ রক্ষা করা সম্ভব। প্রথম ধাপে প্রজনন ক্ষেত্র আলাদা করা, পর্যটক নিয়ন্ত্রণ, এবং পুকুরপাড়ে নরম বালু বিছানোর কাজ শুরু করা উচিত। এরপর ধাপে ধাপে প্রাকৃতিক খাদ্য সরবরাহ বাড়াতে হবে এবং জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে।

বোস্তামী কাছিমের হারিয়ে যাওয়া মানে শুধু একটি প্রজাতির বিলুপ্তি নয়, একটি সাংস্কৃতিক অধ্যায়ের মুছে যাওয়া। তাই এখনই সময়, ইতিহাসকে ধরে রাখার, নীরব জলের বুকে জীবন্ত কিংবদন্তিকে রক্ষার। আজকের এই নীরবতা যেন ভবিষ্যতের আফসোস না হয়ে দাঁড়ায়।