Home আন্তর্জাতিক শাহতুত বাঁধ: তালিবানকে পাশে টেনে পাকিস্তানকে চাপে ফেলা?

শাহতুত বাঁধ: তালিবানকে পাশে টেনে পাকিস্তানকে চাপে ফেলা?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে পানি আজ কেবল প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, বরং এক গভীর কৌশলগত অস্ত্র। ভারত ও পাকিস্তানের টানাপোড়েনের মাঝে, ভারতের কৌশলগত পানিনীতি ও আফগানিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এই অঞ্চলের রাজনৈতিক মানচিত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বিশেষত কাবুল নদীর ওপর শাহতুত বাঁধ নির্মাণে ভারতের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং সিন্ধু চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের জন্য একাধিক দিক থেকে অশনিসঙ্কেত হয়ে উঠেছে।

সিন্ধু চুক্তি স্থগিত: পানি দিয়ে জবাব

১৯৬০ সালে বিশ্ব ব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত সিন্ধু পানি চুক্তি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরল এক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উদাহরণ ছিল। এই চুক্তি অনুযায়ী, ভারতের দখলে থাকা পূর্বাঞ্চলীয় তিনটি নদী বিয়াস, রবি ও সাতলজ ভারতের জন্য নির্ধারিত হয় এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় নদী তিনটি চেনাব, ঝেলাম ও সিন্ধু পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ থাকে। তবে জম্মু ও কাশ্মীরে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষিতে ভারত এই চুক্তির কার্যকারিতা স্থগিতের ঘোষণা দেয়।

এই সিদ্ধান্তের বাস্তব প্রতিফলন হলো ভারত নতুন করে চেনাব ও ঝেলাম নদীতে জলাধার, বিদ্যুৎ প্রকল্প ও সেচব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিচ্ছে। পাকিস্তানের পানি সরবরাহের প্রায় ৮০ শতাংশ এই নদীর উপর নির্ভর করে। পানি প্রবাহে ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি মানে পাকিস্তানের কৃষিকাজ ও হাইড্রোপাওয়ার উৎপাদনে সরাসরি প্রভাব। পাকিস্তানের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি, বিশেষ করে পাঞ্জাব ও সিন্ধু অঞ্চলের উৎপাদন ব্যবস্থা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়তে পারে।

আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনৈতিক সংঘাত

পাকিস্তান ভারতের এই সিদ্ধান্তকে কার্যত ‘যুদ্ধের ঘোষণার’ সামিল বলছে এবং আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু ভারতের যুক্তি হলো, চুক্তি লঙ্ঘনের প্রশ্ন নয়, বরং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদের প্রেক্ষাপটে পুনর্মূল্যায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। জলকে ‘কৌশলগত সম্পদ’ হিসেবে ব্যবহার করা হবে কি না, সেই প্রশ্ন এখন বৈশ্বিক কূটনীতির আলোচ্য বিষয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে।

আফগানিস্তানে ভারতের সক্রিয়তা: কৌশলগত গভীরতা

পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধের ফাঁকে, ভারত এখন আফগানিস্তানে তার উপস্থিতি আরও শক্তিশালী করছে। শাহতুত বাঁধ নির্মাণে ২৩৬ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা এবং প্রকৌশলগত সহায়তা দিয়ে ভারত শুধু কাবুল ও তার আশপাশের ২০ লাখ মানুষের পানীয় জলের সমস্যা সমাধানে অবদান রাখছে না, বরং পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তে এক নতুন পানি কূটনীতির সূত্রপাত ঘটাচ্ছে।

কাবুল নদীর উপর এই বাঁধ নির্মিত হলে তা পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া অঞ্চলের নদীপথেও প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে শুধু পূর্ব সীমান্ত নয়, পশ্চিম দিক থেকেও পাকিস্তানকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে ভারত। এটি আন্তর্জাতিক কৌশলবিদদের কাছে “টুইন ওয়াটার ফ্রন্ট” নীতি হিসেবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে যেখানে একসঙ্গে দুই দিক থেকে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রকে চাপ প্রয়োগ করা হয়।

অর্থনীতি ও প্রযুক্তির প্রভাব

ভারতের এই কৌশলিক বাঁধ এবং নদী নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পগুলো কেবল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং এর সঙ্গে যুক্ত আছে প্রযুক্তি ও অর্থনীতির গভীর সংশ্লেষ। জলাধার নির্মাণ, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টারবাইন স্থাপন এবং নদী ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ার পানির উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করছে। একইসঙ্গে এই প্রকল্পগুলি স্থানীয় কর্মসংস্থান, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সেচব্যবস্থায় ভারতের আভ্যন্তরীণ সক্ষমতাও বাড়িয়ে তুলছে।

অন্যদিকে, পাকিস্তানের অর্থনীতি এমনিতেই মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক ঋণ ও জ্বালানি সংকটে জর্জরিত। এখন পানি সরবরাহেও যদি সংকট তৈরি হয়, তবে কৃষি উৎপাদনে ধস নামতে পারে, যার অভিঘাত দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, মূল্যস্ফীতি এবং কর্মসংস্থান ব্যবস্থায় পড়বে।

ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশ

এই পানি কেন্দ্রিক ভূরাজনীতি দক্ষিণ এশিয়ায় আগামী দশকের অন্যতম উত্তপ্ত ইস্যু হয়ে উঠতে পারে। পানি প্রবাহ নিয়ে দ্বন্দ্ব একসময় সীমান্ত পার হওয়া সন্ত্রাসবাদের চেয়েও বড় নিরাপত্তা হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। ভারত তার প্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং কূটনীতিকে একত্রে কাজে লাগিয়ে একটি নতুন ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য তৈরি করছে, যেখানে পানি হবে চাপ প্রয়োগের অস্ত্র, আর বাঁধ হবে আধিপত্যের প্রতীক।

পাকিস্তানের সামনে এখন দুটি পথ খোলা: হয় তারা আন্তর্জাতিক আদালতে আইনি লড়াই জারি রাখবে, নয়তো তারা নিজেরাও বিকল্প পানির উৎস খুঁজে কৌশল পাল্টাবে। উভয় পথই দীর্ঘ, ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ।

পানি এখন কেবল জীবন নয়, রাজনীতির চালও। ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক যে কোনও সময় নতুন উত্তেজনার পর্যায়ে যেতে পারে বিশেষত যখন দুটি দেশের অর্থনীতি ও নিরাপত্তা পরস্পরবিরোধী গতিপথে চলতে থাকে। আফগানিস্তানে ভারতের উপস্থিতি এবং সিন্ধু চুক্তির স্থগিতাদেশ এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও শক্তির ভারসাম্যে এক বড় পরিবর্তনের সূচনা করতে চলেছে।