Home কলকাতা ভারতে চা খাতে বৈপরীত্যপূর্ণ পরিস্থিতি, নিলামে ব্যাপক দরপতন

ভারতে চা খাতে বৈপরীত্যপূর্ণ পরিস্থিতি, নিলামে ব্যাপক দরপতন

কৃষ্ণা বসু, কলকাতা: ২০২৫ সালে ভারতের চা খাত একটি বৈপরীত্যপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। বছরের শুরুতে উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও মাঝামাঝি সময়ে আবহাওয়ার প্রতিকূলতা, অতিবৃষ্টি ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে উৎপাদনে হ্রাস দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে দেশজুড়ে নিলাম বাজারে চায়ের দর কমে যাওয়ায় চা শিল্পে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

চা বোর্ড অব ইন্ডিয়ার সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ভারতের মোট চা উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৪৬৯.৭ মিলিয়ন কেজি, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৩ শতাংশ বেশি। কিন্তু আগস্ট মাসে উৎপাদন নেমে আসে ১৭০.১২ মিলিয়ন কেজিতে, যেখানে গত বছর একই সময়ে উৎপাদন হয়েছিল ১৮৪.৪৫ মিলিয়ন কেজি। উত্তর ভারতের প্রধান চা উৎপাদন অঞ্চল আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আসামে আগস্টে উৎপাদন কমে দাঁড়ায় ১০৩.৫২ মিলিয়ন কেজি এবং পশ্চিমবঙ্গে ৪৫.৯০ মিলিয়ন কেজি।

চা শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সময়ের আগেই অতিবৃষ্টি এবং গ্রীষ্মে অস্বাভাবিক উষ্ণতা চা গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত করছে। এতে পাতা সংগ্রহে ব্যাঘাত ঘটছে এবং উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে, নিলাম বাজারেও দেখা যাচ্ছে দরপতন। কলকাতা চা নিলাম কেন্দ্রে সাম্প্রতিক সপ্তাহে সিটিসি লিফ ও ডাস্ট চায়ের গড় দর দাঁড়িয়েছে প্রতি কেজি প্রায় ২৩২ টাকা। অথচ বছরের প্রথম দিকে একই মানের চা বিক্রি হতো ২৪৫–২৫০ টাকায়। চা বোর্ড-এর তথ্য বলছে, এপ্রিল থেকে জুলাই সময়কালে আসাম ও দোয়ারস–তেরাই অঞ্চলে নিলামমূল্য যথাক্রমে ৭ ও ৯.৫ শতাংশ কমেছে।

চা উৎপাদক সংগঠনগুলো বলছে, খরচ বৃদ্ধির সঙ্গে তুলনামূলক কম দাম পাওয়া এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা। শ্রমিক মজুরি, সার–কীটনাশক ও পরিবহন খরচ বেড়ে গেলেও নিলামে দাম সেই হারে বাড়ছে না। ফলে অনেক ক্ষুদ্র চা বাগান টিকে থাকার সংগ্রামে রয়েছে।

তবে ইতিবাচক দিকও আছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ভারতের চা রপ্তানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭৪.৪২ মিলিয়ন কেজি, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২ শতাংশ বেশি। রপ্তানিতে গড় দরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রতি কেজি প্রায় ২৯৫ টাকা। বিশেষ করে রাশিয়া, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইউরোপের বাজারে ভারতীয় চায়ের চাহিদা স্থিতিশীল রয়েছে।

তবুও দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চা শিল্পে মুনাফার হার কমছে। গৌহাটি চা নিলাম কেন্দ্রে এই মৌসুমে প্রায় ৩৬ শতাংশ চা বিক্রি হয়নি—যেখানে গত বছর এই অনুপাত ছিল ২৩ শতাংশ। এতে স্পষ্ট যে চায়ের অতিপ্রাচুর্য, মানের ভিন্নতা এবং বাজারে ক্রেতাদের অনিশ্চয়তা দরের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান সংকট মোকাবিলায় সরকারের উচিত চায়ের ন্যূনতম টেকসই মূল্য নির্ধারণ করা এবং চা বাগানগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি ও জলবায়ু সহনশীল কৃষি পদ্ধতির সম্প্রসারণে উদ্যোগ নেওয়া।

একজন আসাম চা উৎপাদক বলেন, “এই পরিস্থিতিতে উৎপাদন বাড়ানো নয়, আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত মানোন্নয়ন ও স্থায়ী বাজার তৈরি করা।”

সব মিলিয়ে ২০২৫ সালে ভারতের চা শিল্প একটি সংবেদনশীল অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। উৎপাদন বৃদ্ধির সূচনা সত্ত্বেও নিলামে দরপতন ও জলবায়ুগত চাপে খাতটির টেকসই প্রবৃদ্ধি এখন বড় প্রশ্নের মুখে।