Home আন্তর্জাতিক ভালোবাসা যেখানে থেমে যায় সীমান্তের কাঁটাতারে

ভালোবাসা যেখানে থেমে যায় সীমান্তের কাঁটাতারে

ছবি সংগৃহীত

দ্বন্দ্বের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে দুই দেশের মানুষে মানুষে সম্পর্ক

আমীরুল মোমেনিন: ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের উত্তপ্ত ইতিহাসে যখনই নতুন কোনো দ্বন্দ্বের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে, দুই দেশের সাধারণ মানুষের মনে হয়ত কৌতূহল কিংবা হাসির আবছা রেখা পড়ে।
কিন্তু এই কাঁটাতারের রাজনীতির মাঝখানে, নিরবে কান্না ফেলে হাজার হাজার হৃদয়— যারা সীমান্ত পেরিয়ে গাঁথা দিয়েছিল ভালোবাসার মালা।

সম্প্রতি জম্মু-কাশ্মীরের পর্যটকদের উপর সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়, বাতিল করা হয় ইন্দাস পানি চুক্তিও।
ভারতের সিদ্ধান্ত নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন তীব্র কটাক্ষ চলছে, তখন সীমান্ত-বাঁধা বিয়ের মানুষগুলো বুকভরা হতাশা নিয়ে তাকিয়ে আছে নিষ্প্রাণ তারের গায়ে।

নয়াদিল্লির আফশান সাইফ, যিনি করাচি থেকে বিয়ে করে ভারতে এসেছিলেন, জানালেন—
“নানাভাই হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছেন। মে মাসে করাচি যাওয়ার কথা ছিল। এখন আর যাওয়া সম্ভব নয়।”
আবার নাসিব আক্তার বিলাল, যিনি দিল্লি থেকে করাচিতে বিয়ে করেছিলেন, ভাঙা কণ্ঠে বললেন,
“বছরের পর বছর ভাইবোনদের দেখিনি। এখন শুধু ভিডিও কলে কথা বলা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।”

নয়াদিল্লির বাসিন্দা মোহাম্মদ সাইফের কথায় উঠে এল এই ক্রস-বর্ডার দাম্পত্যের করুণ বাস্তবতা—
“করোনা মহামারির সময় স্ত্রী করাচিতে আটকে পড়েছিলেন। তখন বুঝেছিলাম এই বিয়ের আসল কঠিন দিক। আজও অন্তত ৩০টি পরিবারকে জানি, যারা একই যন্ত্রণায় ভুগছে।”

কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত আবদুল বাসিত মনে করিয়ে দেন, এই বিবাহগুলো উপমহাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, যেগুলো অগ্রাহ্য করা মানে শান্তির শেষ আশাটুকুও গুঁড়িয়ে দেওয়া। তিনি বলেন,
“এই পরিবারগুলোর আইনি, নাগরিকত্ব, সম্পত্তির অধিকার নিয়ে নানা জটিলতা তৈরি হয়। আলাদা হতে চাইলে সেই বিচ্ছেদও আটকে যায় আন্তর্জাতিক আইনের জটিলতায়।”

অন্যদিকে লাহোর মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারপারসন ড. শবনম গুল জানালেন,
“সীমান্তের দুই পারে পরিবার থাকলে তাঁদের প্রতি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকানো হয়। কখনও কখনও ‘শত্রু দেশের চর’ বলে অপমানও সহ্য করতে হয়।”
ড. গুল আরও বলেন,
“ঘৃণা আর অবিশ্বাসের আবহে ভালোবাসার কণ্ঠস্বর হারিয়ে যায়। নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসা বজায় রেখে অন্য দেশের মানুষের প্রতি ঘৃণা তৈরি করা— এই দ্বন্দ্বে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যক্তিগত সম্পর্ক।”

এই কঠিন বাস্তবতার আলোকে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন একটি “ফ্যামিলি ভিসা কার্ড” চালু করার, যাতে জরুরি পরিস্থিতিতে যেমন রোগ বা মৃত্যুর সময়, সীমান্ত পার হওয়া সহজ হয়।
তারা ওয়াঘা-আটারি সীমান্তে একটি নির্দিষ্ট পারিবারিক করিডোর খোলার প্রস্তাবও দিয়েছেন, যেখানে নিয়মিত পরিবারের সদস্যদের দেখা করার সুযোগ থাকবে।

ভালোবাসা কি কাঁটাতার বোঝে?
সীমান্তের দু’পারে যখন দু’টি হৃদয় মিশে যায়, তাদের চাওয়া হয় খুবই সাধারণ— কিছু মুহূর্তের ছোঁয়া, কিছু আপনজনের উষ্ণতা।
কিন্তু রাষ্ট্রের কঠিন দেয়ালে সেই সাধারণ চাওয়াগুলো আজ পরিণত হয়েছে দুর্লভ স্বপ্নে।
কাঁটাতারের একেকটি ফোঁটায় জমে আছে অগণিত অশ্রুবিন্দু, হারিয়ে যাওয়া স্পর্শের বেদনা।

হয়তো একদিন, শত্রুতার এই বিশাল দেয়াল ভেঙে পড়বে।
হয়তো একদিন, ভালোবাসা জয় করবে পুরনো বিদ্বেষের গন্ধমাখা ইতিহাস।
সেই স্বপ্নেই, সীমান্তের দুই পারে কিছু মানুষ এখনো অপেক্ষায়— একটিবার, ভালোবাসার মুক্ত হাওয়া ছুঁয়ে দেখার জন্য।

:পাকিস্তানের এক্সপ্রেস ট্রিবিউন অবলম্বনে