Home চট্টগ্রাম চাকসু নির্বাচনের দিনে স্মরণ: ভিপি নাজিম, শেষ নির্বাচিত নেতার অনন্ত উপস্থিতি

চাকসু নির্বাচনের দিনে স্মরণ: ভিপি নাজিম, শেষ নির্বাচিত নেতার অনন্ত উপস্থিতি

ভিপি নাজিম

কামরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড়ি ক্যাম্পাস আজ আবারো সরগরম। লাল-সবুজ ব্যানার উড়ছে, ভোর থেকেই লাইন পড়ে গেছে ভোটকেন্দ্রগুলোতে। কেউ উত্তেজনায় বলছে—“আজ ইতিহাস ফিরে এসেছে!” কিন্তু এই ইতিহাসের মূল প্রেক্ষাপটে, এক অনুপস্থিত মানুষ যেন ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন ক্যাম্পাসজুড়ে। তাঁর নাম মো. নাজিম উদ্দিন। সবার কাছে চিরপরিচিত ‘ভিপি নাজিম’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু)-এর সর্বশেষ নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। সেই নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯০ সালে। তারপর কেটে গেছে তিন যুগ। ক্যাম্পাসে আর হয়নি চাকসু নির্বাচন। আজ, ১৫ অক্টোবর ২০২৫—যে দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভোটগ্রহণ চলছে, ঠিক এই দিনেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম মনে করছে সেই মানুষটিকে, যিনি ছিলেন চাকসুর ইতিহাসের শেষ নির্বাচিত ভিপি।

মাঝখানে ভিপি নাজিম। তার ডানে তৎকালীন জিএস আজিম উদ্দিন এবং বামপাশে চাকসুর প্রাক্তন জিএস জমির চৌধুরী।

তখন সময়টা উত্তাল রাজনীতির। জাতীয় ছাত্রলীগের ব্যানারে তরুণ নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে উঠেছিল পরিবর্তনের জোয়ার। ছাত্রস্বার্থ, ন্যায়, গণতন্ত্র—এই তিনটি শব্দই ছিল তাঁর রাজনীতির মন্ত্র। চাকসুর সেই নির্বাচনে জয় পেয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন শুধু একজন নেতা নয়, বরং ছাত্র আন্দোলনের এক জ্যোতির্বলয়। তাঁর বক্তৃতায় ছিল দৃঢ় যুক্তি, চোখে ঝলক দিত আত্মবিশ্বাসের আগুন।

পরে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। একসময় বিএনপির রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু রাজনীতির জটিল বাস্তবতার মধ্যেও তিনি হারাননি তাঁর ‘মানুষের পাশে থাকার’ প্রবণতা। ২০২৩ সালে তিনি নতুন রাজনৈতিক সংগঠন ‘প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ফোরাম’ প্রতিষ্ঠা করেন, একদল তরুণকে সঙ্গে নিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল—শুদ্ধ, প্রগতিশীল ও মানুষকেন্দ্রিক রাজনীতি গড়ে তোলা। সংগঠনের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি আবারও ফিরে আসেন নেতৃত্বের আলোচনায়।

চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ফতেপুর গ্রামের সন্তান নাজিম উদ্দিনের জীবনের গল্পও মাটির মতোই বিনয়ী। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ছিলেন বিতর্কপ্রিয়, চিন্তাশীল এবং সহপাঠীদের মধ্যে জনপ্রিয় এক মুখ। সহপাঠীরা বলেন— “ভিপি নাজিম শুধু বক্তা ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক চিন্তার উৎস। তাঁর চোখে আমরা দেখেছি নেতৃত্বের সৎ আভা।”

চট্টগ্রামের রাজনীতিতেও তাঁকে সবাই চিনতো এক সহজ, দৃঢ়চেতা মানুষ হিসেবে। তাঁকে ডাকলেই সাড়া মিলতো, তর্কে ক্ষোভ নয়, বরং হাসিই ছিল তাঁর জবাব।

কিডনি জটিলতায় দীর্ঘদিন ভুগছিলেন নাজিম উদ্দিন। চিকিৎসাধীন ছিলেন ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। কিডনি প্রতিস্থাপন অপারেশনের পর কিছুদিন আশার আলো দেখা গেলেও অবশেষে ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সালে, ৬৮ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চট্টগ্রাম নগরের জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদে জানাজা শেষে তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় নিজ গ্রাম ফতেপুরে, যেখানে শিশুকালের স্বপ্নমাখা মাটিতে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। স্ত্রী ও তিন পুত্র রেখে গেছেন তিনি। রেখে গেছেন আরও বড় কিছু—এক ইতিহাস, এক আস্থা, এক নাম—‘ভিপি নাজিম’।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যে প্রজন্ম আজ ব্যালটে ছাপ ফেলছে, তারা নাজিম উদ্দিনকে দেখেনি। কিন্তু তাঁর গল্প শোনে—শিক্ষকদের মুখে, পুরনো ব্যাচের ভাইদের কথায়, কিংবা সিএনজির পথে পুরনো পোস্টার ঝুলতে থাকা কোনো নামের ফিসফিসে স্মৃতিতে। আজকের চাকসু নির্বাচনের দিনে কেউ কেউ মৃদু কণ্ঠে বলছে: “ভিপি নাজিম বেঁচে থাকলে আজকের দিনটা তাঁর সবচেয়ে প্রিয় হতো।”

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা, আর্টস ভবনের বারান্দা, কিংবা রেলগেটের চায়ের দোকানে তাঁর নাম উচ্চারিত হচ্ছে শ্রদ্ধায়, গর্বে, আর এক ধরনের নস্টালজিয়ায়।

চাকসু আজ ফিরে পেয়েছে তার প্রাণ, কিন্তু সেই প্রাণের ইতিহাস শুরু হয়েছিল যে প্রজন্মের হাতে, তার নেতৃত্বে ছিলেন ভিপি নাজিম। তাঁর পর থেকে দীর্ঘ বিরতি—তিন দশকের শূন্যতা। আজ সেই শূন্যতার মধ্য দিয়েই যেন তিনি ফিরে এসেছেন প্রতীক হয়ে। এক সাবেক ছাত্রনেতা আজ বলেন “আজকের নির্বাচন যতটা নতুন শুরুর, ততটাই এটি এক শ্রদ্ধাঞ্জলি নাজিম ভাইদের প্রজন্মের প্রতি, যারা আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন।”

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর নামের আগে ‘ভিপি’ শব্দটি লেগে ছিল। সেটি ছিল শুধু পদ নয়, বরং এক ইতিহাসের প্রতীক। তিনি একবার বলেছিলেন—“ছাত্ররাজনীতি যদি সৎ হয়, তবে সময়ই তার সাক্ষ্য দেবে।”

আজ, ১৫ অক্টোবর ২০২৫—চাকসুর ভোটের দিনে সময় যেন সত্যিই সাক্ষ্য দিচ্ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাতাসে ভেসে আসছে সেই নাম—ভিপি নাজিম।

📍বিজনেসটুডে২৪ মন্তব্য:
চাকসুর নতুন ইতিহাস লিখছে আজকের প্রজন্ম, কিন্তু এই ইতিহাসের পাতায় অক্ষয় হয়ে রইলেন একজন, মো. নাজিম উদ্দিন। শেষ নির্বাচিত ভিপি হয়েও তিনি যেন আজকের প্রতিটি ব্যালটে, প্রতিটি স্লোগানে, প্রতিটি স্মৃতিতে অনন্তভাবে বেঁচে আছেন।