Home পরিবেশ আইনে মহাবিপন্ন, বাস্তবে নিলামে: বাগাড়ের করুণ পরিণতি

আইনে মহাবিপন্ন, বাস্তবে নিলামে: বাগাড়ের করুণ পরিণতি

ছবি সংগৃহীত

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: পদ্মা নদী এক সময় পরিচিত ছিল বিরল ও বড় আকারের নানা প্রজাতির মাছের নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে। বর্ষা নামলেই নদীর পাড়ে মুখে মুখে ফিরত বিশাল রুই, কাতলা বা বাঘাইড় ধরার রোমাঞ্চকর কাহিনি। সেই ধারাবাহিকতায় গতকাল শনিবার রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় ধরা পড়ে প্রায় ৫০ কেজির এক বিশাল বাঘাইড় মাছ। মাছটি বাজারে আনা মাত্রই এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা, সৃষ্টি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ।

স্থানীয় জেলে ছিদ্দিক হালদার ও তার সহযোগীরা পদ্মার ওই অংশে জাল ফেলেছিলেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর হঠাৎ জালে প্রচণ্ড টান লাগলে সবাই মিলে জাল তুলে আনেন এবং দেখতে পান বিরল ও বিশালাকৃতির বাঘাইড় মাছটি। পরে মাছটি নিয়ে আসা হয় দৌলতদিয়া বাজারে, যেখানে রেজাউলের আড়তে একটি উন্মুক্ত নিলাম আয়োজিত হয়। প্রতি কেজি ১ হাজার ৫৫০ টাকা দরে মাছটি কিনে নেন স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. চান্দু মোল্লা। মোট দাম পড়ে ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা।

ক্রেতা চান্দু মোল্লা বলেন, “পদ্মার বড় বাঘাইড় সবসময়ই চাহিদাসম্পন্ন। এই মাছ ঢাকার নামি হোটেল, রেস্তোরাঁ আর প্রবাসী ক্রেতাদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। আমি প্রতি কেজি ১০০ টাকা লাভে বিক্রি করতে চাই এবং এরই মধ্যে দেশ-বিদেশের কিছু ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করছি।”

তবে এই আনন্দঘন পরিবেশের মধ্যেও উঁকি দিচ্ছে এক অস্বস্তিকর প্রশ্ন—পদ্মা কি ধীরে ধীরে হারাচ্ছে তার বিশাল মাছের ঐতিহ্য? আর কেনই বা আইইউসিএন-এর ‘মহাবিপন্ন’ তালিকাভুক্ত এমন মাছগুলো প্রকাশ্যে ধরা, বিক্রি ও পরিবহনের পরও আইনের কার্যকর প্রয়োগ হচ্ছে না?

এক নজরে বিশাল বাগাড়ের অতীত রেকর্ড

বিগত এক দশকে পদ্মা নদীতে বিভিন্ন সময় বিশাল আকৃতির বাগাড় মাছ ধরা পড়ার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিচে তুলে ধরা হলো:

মার্চ ২০২২, রাজবাড়ী:
দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকায় ৬০ কেজির বাগাড় ধরা পড়ে। জেলে মোহাম্মদ আলী মাছটি ধরেন এবং পরে এটি ৭৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।

জুলাই ২০২১, মাদারীপুর:
শিবচরের কাঁঠালবাড়ি ঘাটের কাছে পদ্মা নদীতে ৫৭ কেজির একটি বাগাড় মাছ ধরা পড়ে। ঢাকার এক ব্যবসায়ী মাছটি কিনে নিয়ে যান।

জুন ২০১৮, রাজবাড়ী:
৫৫ কেজির একটি বাগাড় ধরা পড়ে, যা ঘাট এলাকায় বহু মানুষের কৌতূহল তৈরি করেছিল।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে পদ্মার শাখা নদীতে (যশোর):
ধরা পড়ে প্রায় ৪৯ কেজির একটি বাগাড় মাছ।

এইসব তথ্য থেকে বোঝা যায়, এক সময় পদ্মা নদীতে প্রায় নিয়মিতভাবেই ৫০ কেজি বা তার বেশি ওজনের বাগাড় ধরা পড়ত। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেই সংখ্যায় বড় ধরনের ভাটার টান পড়েছে।

মহাবিপন্ন প্রজাতি: আইনের নজরবিহীনতা

বাগাড় মাছ আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন)-এর তালিকায় ‘মহাবিপন্ন’ বা Critically Endangered প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত। অথচ বাস্তবচিত্র হলো, শনিবার ফরিদপুরে ধরা পড়া মাছটি প্রকাশ্যেই নিলামে তোলা হয় এবং ১৮ জন মিলে ৬২ হাজার টাকায় কিনে নেন—যা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন, ২০১২ অনুযায়ী সম্পূর্ণভাবে দণ্ডনীয় অপরাধ।

তবে জেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের বক্তব্য ভিন্ন। ফরিদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার বলেন, “মৎস্য সংরক্ষণ আইনে বাগাড় ধরা নিষিদ্ধ নয়। আমরা সাধারণত ছোট মাছের (যেমন ইলিশের ঝাটকা) ওপর নজর দিই।” তিনি আরও জানান, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের বাস্তবায়ন মৎস্য অধিদপ্তরের কাজ নয়, এটি প্রশাসনের দায়িত্ব।

নদীর বিশাল প্রাণী কোথায় হারাচ্ছে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত শিকার, নদী দূষণ, ড্রেজিং, এবং প্রজননকালে নির্বিচারে মাছ ধরা—এসবই নদীর বিশাল প্রাণীদের অস্তিত্ব সংকটে ফেলছে। একসময় পদ্মায় যেসব মাছ ৬০-৭০ কেজি পর্যন্ত হতো, বর্তমানে সেগুলো ৩০-৪০ কেজিতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

বন্যপ্রাণী গবেষকরা বলছেন, এই প্রজাতিগুলোর বিলুপ্তি শুধু নদীর জীববৈচিত্র্যই নয়, জেলেদের ভবিষ্যৎ জীবন ও প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তার ওপরও সরাসরি প্রভাব ফেলবে।
সমাধান কী?

১. আইন বাস্তবায়নের সমন্বিত উদ্যোগ – মৎস্য ও পরিবেশ অধিদপ্তরের যৌথ কার্যক্রম
২. জেলেদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ
৩. নদীতে মাছের প্রজনন মৌসুমে নিরবচ্ছিন্ন নিষেধাজ্ঞা
৪. বড় মাছ ধরা ও বিক্রির তথ্য সংগ্রহ ও নজরদারি বৃদ্ধি

পদ্মা নদী শুধু জল নয়, এটি এ দেশের জীববৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সেই ইতিহাসের অন্যতম সাক্ষী বাগাড় মাছ যেন না হারিয়ে যায় সময়ের স্রোতে।

আপনিও কী কখনও এমন বিশাল মাছ দেখেছেন পদ্মায়? নিচে কমেন্ট করুন আপনার অভিজ্ঞতা!
এই প্রতিবেদনটি ভালো লাগলে শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন অন্যদের কাছে। আরও এমন সংবাদ পেতে লাইক করুন আমাদের পেজ এবং চোখ রাখুন বিজনেসটুডে২৪.কম-এ।