Home Third Lead বার্ন ইনস্টিটিউট: বাতাস ভারী কান্না আর আর্তনাদে

বার্ন ইনস্টিটিউট: বাতাস ভারী কান্না আর আর্তনাদে

ছবি সংগৃহীত
বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: রাত তখন নয়টা। ঢাকার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সামনে থমথমে এক পরিবেশ। বাতাস ভারী কান্না আর আর্তনাদে। যে কান্না শিশুদের—যাদের গায়ে আগুন লেগেছে, স্বপ্ন জ্বলেছে, আর জীবন হয়ে উঠেছে অসহনীয়। কেউ চিৎকার করে কাঁদছে, কেউ নিঃশ্বাস নিচ্ছে অক্সিজেন মাস্কে, কেউ অচেতন। বাইরে অপেক্ষমাণ স্বজনদের চোখে শুধু আতঙ্ক আর প্রার্থনা।

সোমবার বিকেলে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে স্কুল ভবনে। সেই আগুনে দগ্ধ হয় শিশু শিক্ষার্থীরা। যাদের বয়স সাত, নয়, দশ, কেউ বা পনেরো। এখন তারা হাসপাতালের শয্যায়—দগ্ধ শরীর নিয়ে জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে ভেসে আছে।

১০ বছরের আয়ান রশীদ সকালে বলেছিল, ‘আজ স্কুলে নতুন কবিতা শিখবে’। বিকেলে সেই কবিতা নয়, আগুনে ঝলসে যাওয়া বুক আর মুখ নিয়ে তার লড়াই চলছে বার্ন ইউনিটে। তার মা কানিজ ফারহানা বারবার বলছেন, ‘যার শরীরে কখনও ঘা হয়নি, আজ আগুনে জ্বলেছে আমার ছেলে।’

রুবাইয়াত ফারিহা, বয়স মাত্র সাত। নার্সারির শিক্ষার্থী। দুর্ঘটনার সময় নিচতলায় ছিল। এখন তার চোখে-মুখে ব্যান্ডেজ। মা কাছে গেলেই বলছে, ‘আম্মু, পানি দাও, খুব জ্বালা করে।’ সেই ছোট্ট কণ্ঠের আর্তি যেন হাসপাতালের দেয়াল ভেদ করে আকাশ পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে।

একটি একটি করে শিশুদের খবর আসছে, আর সঙ্গে সঙ্গে কোনো না কোনো মা মাটিতে লুটিয়ে পড়ছেন। এক নারী হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়েন, শুনেছেন তাঁর সন্তানের অবস্থা সংকটজনক। বার্ন ইউনিটের করিডোরে এখন শুধুই কান্না আর দুশ্চিন্তা।

চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মেহরিনের শরীর পোড়া, কাপড়ে আগুন লেগেছিল। তার মামা ফাহাদ নিয়ন বলছিলেন, ‘২ ঘণ্টা ধরে খুঁজেছি। পরে জানতে পারি বার্ন ইউনিটে। এসে দেখি, মুখ, হাত সব পুড়ে গেছে।’

৫২০ নম্বর কক্ষে ইয়াসমিন আক্তার হাউমাউ করে কাঁদছেন। তাঁর মেয়ে ইউশা—পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। কপাল, মুখ, মাথা, পিঠ—সব জায়গায় আগুনের দাগ। ইউশা বলে, ‘মা, আমার সব জ্বলে।’

রবিউল হাসান রোহানের মা নাসিমা বেগম বলেন, ‘আমার রোহান কই, ও খুব যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।’ পাশে দাঁড়িয়ে বাবা নিজাম উদ্দিন নিঃশব্দে চোখ মুছছিলেন।

এক অভিভাবক কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘ছেলেটা সকালে বলেছিল, বাবা, আজ স্কুলে যেতে মন চাইছে না। যদি শুনতাম, যদি বিশ্বাস করতাম!’

আরিয়ানের মা আঁখি বলছেন, ‘সকালে খাবার খাইয়ে পাঠালাম। এখন ওর পুরো শরীর পুড়ে গেছে। আমি আল্লাহর কাছে শুধু চাই, আমার সন্তানকে আবার যেন বুকে জড়িয়ে ধরতে পারি।’

বার্ন ইনস্টিটিউটে এই মুহূর্তে কোনো শয্যা খালি নেই। নার্স তাহমিনা বললেন, ‘তারা ব্যথা বোঝাতে পারে না, শুধু কাঁদে। আমরা যখন ব্যান্ডেজ পাল্টাই, তখন আমাদের চোখও ভিজে যায়।’

এই শিশুরা কোনো অপরাধ করেনি। তারা শুধু স্কুলে গিয়েছিল—নতুন কবিতা শেখার জন্য, ছবি আঁকার জন্য, বন্ধুদের সঙ্গে হাসার জন্য। কিন্তু আজ, তারা জীবন বাঁচানোর জন্য লড়ছে। আর তাদের বাবা-মা দাঁড়িয়ে আছেন দগ্ধ স্বপ্নের ছায়ায়।