Home অন্যান্য মাতারবাড়ির স্বপ্নবীজ ও একটি টাইপ রাইটারে লেখা কাগজ

মাতারবাড়ির স্বপ্নবীজ ও একটি টাইপ রাইটারে লেখা কাগজ

ছবি: এ আই

 গভীর সমুদ্র বন্দর নিয়ে প্রথম রিপোর্টের নেপথ্য গল্প

কামরুল ইসলাম

আজ যখন পত্রিকার পাতা ওল্টালেই মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের বিশাল কর্মযজ্ঞের ছবি দেখি, কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় দেখি নীল জলরাশির বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির নতুন লাইফলাইন, তখন আমার মনটা এক ঝটকায় ৪১ বছর পেছনে চলে যায়। সালটা ১৯৮৪। আজকের মতো তখনো হাতে হাতে স্মার্টফোন নেই, গুগল নেই, তথ্যের এত অবাধ প্রবাহ নেই। সাংবাদিকতা তখন ছিল জুতোর তলা ক্ষয় করা আর ধুলোবালি মাখা এক রোমাঞ্চকর নেশা।

আমি তখন ‘দৈনিক সংবাদ’-এর স্টাফ রিপোর্টার। খবরের পেছনে ছুটছি বিরামহীন। চট্টগ্রাম বন্দর তখন দেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড, আর সেই হৃৎপিণ্ডেই আমার নিয়মিত যাতায়াত।

একদিন চট্টগ্রাম বন্দর ভবনে গিয়েছি। কথা হচ্ছে তৎকালীন সদস্য (অপারেশন) ক্যাপ্টেন এম এল রহমানের সঙ্গে। অসম্ভব দূরদর্শী আর প্রজ্ঞাবান একজন মানুষ ছিলেন তিনি। কথার ফাঁকে হঠাৎ তিনি টেবিলের ড্রয়ার থেকে ইংরেজিতে টাইপ করা একটি কাগজ বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। বললেন, “কামরুল সাহেব, এটা একটু পড়ে দেখুন তো।”

কাগজটা হাতে নিলাম। সাদামাটা কয়েকটা পৃষ্ঠা, কিন্তু তাতে লেখা ছিল এক বিপ্লবের রূপরেখা। ক্যাপ্টেন রহমান ওই কাগজে ‘ডিপ সি পোর্ট’ বা গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরির উপযোগিতা ও সম্ভাব্যতা নিয়ে একটি খসড়া দাঁড় করিয়েছিলেন।

পড়তে পড়তে আমার চোখ আটকে গেল একটি তথ্যে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন একটি বিশালকায় জাহাজের কথা। বিদেশি সেই মাদার ভেসেলটি ভর্তি ছিল অনুদান হিসেবে পাঠানো গমে। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের ড্রাফট কম হওয়ায় সেটি জেটিতে ভিড়তে পারেনি। নোঙর করতে হয়েছিল কুতুবদিয়ার গভীর সমুদ্রে। আর লাইটার জাহাজে করে সেই গম খালাস করতে সময় লেগেছিল প্রায় ৬ মাস! ভাবা যায়? একটি জাহাজ খালি করতে যদি ছয় মাস লাগে, তবে অর্থনীতির চাকা ঘুরবে কী করে?

ক্যাপ্টেন এম এল রহমান ওই কাগজে দেখিয়েছিলেন, মহেশখালী চ্যানেলই হতে পারে এই সমস্যার একমাত্র সমাধান। সেখানেই গড়ে তোলা সম্ভব বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, তিনিই ছিলেন সেই প্রথম ব্যক্তি, যিনি আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও, চিন্তার জগতে গভীর সমুদ্র বন্দরের বীজটা বুনেছিলেন।

সাংবাদিক হিসেবে আমার ‘সিক্সথ সেন্স’ বলছিল, এটা কোনো সাধারণ কাগজ নয়, এটা আগামীর বাংলাদেশের ভাগ্যলিপি। কিন্তু সাংবাদিকতা মানে তো শুধু কারো মুখের কথা বা কাগজের ওপর ভিত্তি করে রিপোর্ট করা নয়, প্রয়োজন যাচাই-বাছাই।

আমি যোগাযোগ করলাম তৎকালীন বন্দর, জাহাজ চলাচল ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, ক্যাপ্টেন এম এল রহমান মন্ত্রণালয়ের নজরে আনার জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকটা সে রকমই একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। যদিও সেটি কোনো অফিসিয়াল ফাইল বা প্রপোজাল ছিল না, বরং ছিল একজন দেশপ্রেমিক কর্মকর্তার ‘ডেমিন-অফিসিয়াল’ বা আধা-সরকারি পত্র। মন্ত্রণালয় তখনো বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে না দেখলেও, ফাইলের কোনো এক কোণায় সেটি জায়গা করে নিয়েছিল।

ব্যাস, আমার আর কী চাই! তথ্যের সত্যতা পেলাম, পেলাম একজন ভিশনারি মানুষের স্বপ্ন। আর দেরি করলাম না। ‘দৈনিক সংবাদ’-এর প্রথম পাতায় ফলাও করে ছাপা হলো আমার রিপোর্ট। শিরোনামটা ঠিক এখন মনে নেই, তবে বিষয়বস্তু ছিল—‘মহেশখালী চ্যানেলে গভীর সমুদ্র বন্দরের অপার সম্ভাবনা’।

সেটাই ছিল বাংলাদেশের কোনো সংবাদপত্রে গভীর সমুদ্র বন্দর নিয়ে প্রকাশিত প্রথম রিপোর্ট। আজ গর্ব করে বলতে পারি, এই ইতিহাসের প্রথম সাক্ষী ও দাবিদার আমি। রিপোর্টটি প্রকাশের পর বেশ হইচই পড়ে গেল। নীতিনির্ধারণী মহলে শুরু হলো গুঞ্জন। এর গুরুত্ব অনুধাবন করে ‘সংবাদ’-এ পরবর্তীতে একটি সম্পাদকীয়ও ছাপা হয়েছিল।

আজ চার দশকের বেশি সময় পর, যখন মহেশখালী আর মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দরের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে, তখন খুব করে মনে পড়ছে ক্যাপ্টেন এম এল রহমানের কথা। সেই ১৯৮২ সালে, টাইপ রাইটারে খটখট করে লেখা সেই কাগজটিতে তিনি যে স্বপ্ন এঁকেছিলেন, আর আমি যে স্বপ্নের কথা কালির অক্ষরে দেশবাসীকে জানিয়েছিলাম, তা আজ সত্য।

ইতিহাস সবসময় বড় বড় স্থাপনার কথা মনে রাখে, কিন্তু সেই স্থাপনার পেছনের প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা কিংবা সেই স্বপ্নকে শব্দের গাঁথুনিতে প্রথম তুলে ধরা রিপোর্টারকে কি মনে রাখে? হয়তো রাখে না। কিন্তু আজ নিজের ডায়েরির পাতা উল্টে বলতে ইচ্ছে হলো, এই স্বপ্নের শুরুটা আমাদের হাত ধরেই হয়েছিল।