সম্পাদকীয়
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মাহরিন চৌধুরীর মৃত্যু শুধু একটি ব্যক্তি বা একটি প্রতিষ্ঠানের শোক নয়, এটি গোটা জাতির জন্য এক আত্মজিজ্ঞাসার মুহূর্ত। বিমান বিধ্বস্ত হয়ে যখন স্কুল ভবনে আগুন ধরে যায়, তখন তিনি শিক্ষার্থীদের নিয়ে যে ভূমিকা পালন করেছেন, তা এক অনন্য মানবিকতার প্রতিচ্ছবি। আগুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে একে একে প্রায় বিশটি শিশুকে বের করে আনা, আর সেই চেষ্টায় নিজে পুড়ে দগ্ধ হয়ে মৃত্যু, এমন আত্মত্যাগ আজকের সমাজে বিরলই নয়, বরং প্রায় অবিশ্বাস্য।
মাহরিন চৌধুরী আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন—একজন প্রকৃত শিক্ষক কেবল পেশাদার নন, তিনি মা, অভিভাবক, রক্ষাকর্তা। প্রশ্ন উঠতেই পারে, একজন শিক্ষকের কতটুকু দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের জীবনের প্রতি? কিন্তু মাহরিন সে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন নিজের জীবন দিয়ে। তিনি যদি চেয়ে নিতেন, ক্লাসরুমে পেছনের খোলা ফাঁকা পথ দিয়ে নিজে বেরিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি বারবার ফিরে গেছেন ভেতরে, বারবার কোলে তুলে দিয়েছেন শিশুদের, যাদের মধ্যে কেউ হয়তো জীবনে প্রথমবার আগুন দেখেছে, কেউ বাঁচতে চেয়েছিল তাঁরই হাত ধরে।
আমরা এই আত্মদানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। তবে এর বাইরে গিয়ে আমাদের ভাবতে হবে, এই ঘটনা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে কী বার্তা দিল?
প্রথমত, জরুরি পরিস্থিতিতে বিদ্যালয়গুলোর প্রস্তুতির অভাব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই দুর্ঘটনা। এমন দুর্ঘটনায় নিরাপত্তা প্রটোকল, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ এবং দুর্যোগ প্রতিক্রিয়ায় কাঠামোগত দুর্বলতা গভীরভাবে সামনে এসেছে। প্রশ্ন থেকে যায়—একটি স্কুল ভবনে বিমানের মতো ঝুঁকি কীভাবে তৈরি হলো, আর এতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল কি?
দ্বিতীয়ত, একজন শিক্ষকের জীবন এখনো কতটা মূল্যায়িত হয় আমাদের সমাজে? মাহরিনের আত্মত্যাগের পর আমরা যদি কেবল কিছু ফুলের তোড়া আর একদিনের শোকানুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ থাকি, তবে সেটি হবে তাঁর আত্মত্যাগের প্রতি চরম অবমাননা। তাঁর নামে একটি শিক্ষাবৃত্তি, একটি ভবন, এমনকি একটি জাতীয় স্বীকৃতি থাকা উচিত যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানাবে, একজন শিক্ষকের সাহসিকতা কেমন হতে পারে।
এ সমাজে যেখানে শিক্ষকের পেশাগত মর্যাদা বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়, সেখানে মাহরিন চৌধুরী প্রমাণ করে গেছেন এই পেশা কেবল চাকরি নয়, এটি এক মানবিক আদর্শের অনুসরণ।
আমরা চাই, মাহরিন চৌধুরীর আত্মত্যাগ যেন কেবল আবেগঘন স্মৃতি না হয়, বরং হয়ে উঠুক পরিবর্তনের প্রেরণা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নীতিনির্ধারণে, দুর্যোগ মোকাবেলায়, শিক্ষক মর্যাদা রক্ষায় এবং শিশুদের নিরাপত্তায় যেন এই ঘটনার আলো প্রতিফলিত হয়।
এই সাহসী শিক্ষিকার প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁর সন্তানদের জন্য রাষ্ট্রীয় সহায়তা এবং তাঁর আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব এখন আমাদের সবার।