ভ্রমণ কাহিনি
কৃষ্ণা বসু, কলকাতা: তামিলনাড়ুর সেই ভোরটা যেন ছিল প্রাচীন কোনও শ্লোকের মতো। রক্তিম আলো মেখে সূর্য উঠছিল ধীরে ধীরে, আর আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম মাদুরাইয়ের মিনাক্ষী মন্দিরের প্রবেশপথে। চারদিকে শঙ্খধ্বনি, মন্দ্র সুরের মন্ত্রপাঠ আর ফুলবিক্রেতার করুণ হাঁক। মনে হচ্ছিল, কোনো পুরাকাল ফিরে এসেছে এই মুহূর্তে।
মিনাক্ষী মন্দির শুধু একটা ধর্মীয় স্থাপনা নয়, এটা এক বিশাল শ্বাস-প্রশ্বাস। গোপুরমের নিখুঁত নকশা, হাজার হাজার দেবমূর্তির চোখ, মাধুর্য ছড়ানো দেয়ালচিত্র সব মিলিয়ে যেন এক নিঃশব্দ কথোপকথন ঈশ্বর ও মানুষের মাঝে। মনে হচ্ছিল, এই স্থাপত্য আমার ভেতরের সেই ভাষাকে স্পর্শ করছে, যা কোনোদিন উচ্চারণ করতে পারিনি।
আমি ধীরে ধীরে হাঁটছিলাম ভিতরে। পাথরের শীতল মেঝে, ধূপের ধোঁয়া আর মানুষজনের মৌনতা এক আশ্চর্য সুর সৃষ্টি করছিল। পাশেই এক বৃদ্ধা ঠাকুরের সামনে বসে একাগ্রচিত্তে প্রার্থনা করছিলেন। তাঁর চোখের পাতা ভেজা, মুখে কোনো শব্দ নেই, তবু তার প্রার্থনা যেন কাঁপিয়ে দিচ্ছে দেবমূর্তিকে।
মন্দিরের ভিতরে দাঁড়িয়ে মনে হলো, সময় এখানে থেমে গেছে। মোবাইলের শব্দ, বাইরের শহরের কোলাহল, কিংবা জীবনের প্রতিদিনের অস্থিরতা এখানে প্রবেশ করেনি। এখানে শুধু আত্মার নির্জনতা আর একটি অদৃশ্য আলোর প্রবাহ। একেকটি স্তম্ভ যেন বহন করে শতাব্দীর ইতিহাস, আর প্রতিটি মূর্তি বলে যায় কোনো মৌন ভাষায় মানুষের আশা, ভয়, আর ভালবাসার কথা।
হঠাৎ করে মনে হলো, আমি আর কোনো পর্যটক নই। আমি এই স্থাপত্যেরই এক অংশ, এই প্রাচীন সংস্কৃতির এক ক্ষণিক অনুরণন। মাথা নিচু করে একবার চোখ বুজে নিলাম। প্রার্থনা করলাম না, বরং নিজের সমস্ত চিৎকার আর ক্লান্তি ছেড়ে দিলাম বাতাসে। যেন দেবমূর্তি শুনে নেবে সেই নিঃশব্দ আহ্বান।
সেদিনের প্রার্থনা শেষ হয়েছিল না, কিংবা হয়তো সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল ভেতরের আরেকটি যাত্রা। আমি বেরিয়ে এলাম মন্দির থেকে, চোখে ছিল এক অদ্ভুত তৃপ্তি, আর বুকের গভীরে এক শান্ত শব্দ, যা কেবল অনুভব করা যায়, প্রকাশ করা যায় না।










