বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক: মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস মানেই শুধু যুদ্ধ আর সিংহাসনের খেলা নয়, এর ভেতর লুকিয়ে আছে প্রেম, ষড়যন্ত্র আর উত্তরাধিকারের টানাপোড়েন। সম্রাট আকবর ও শাহজাহানের জীবনকে ঘিরে এই দুই রঙের কাহিনি আজও মানুষের কল্পনায় দোলা দেয়।
আকবর যখন কিশোর বয়সে সিংহাসনে বসেন, সাম্রাজ্য তখন অস্থিরতার মধ্যে। যুদ্ধ তার কাছে ছিল প্রয়োজনীয়, কিন্তু রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে শুধু তরবারি যথেষ্ট নয় এটা তিনি দ্রুতই বুঝে ফেলেছিলেন। তাই তিনি জোট গড়লেন রাজপুতদের সঙ্গে। একদিন রাজপুত রাজা ভগবন্ত দাসের প্রাসাদে অনুষ্ঠিত বিয়ের আয়োজনে সবাই অবাক হয়ে দেখল, সম্রাট আকবর বিয়ে করছেন জোধাবাইকে, এক হিন্দু রাজকন্যা। এই বিবাহ কেবল প্রেমের নয়, এটি ছিল সাম্রাজ্যের ভিত্তি মজবুত করার এক মহা কৌশল। আকবর তার রাণীকে সম্মান দিলেন, ধর্মীয় সহনশীলতার নীতি চালু করলেন। ফলে সাম্রাজ্যের নানা জাতি ও ধর্ম এক ছাতার নিচে আসতে শুরু করল। হারেম তখন কেবল রাজপ্রাসাদের অলংকার নয়, ছিল এক ধরনের রাজনৈতিক আসর, যেখানে বিবাহ আর আত্মীয়তার সূত্রে গড়ে উঠত ক্ষমতার সমীকরণ।
কয়েক প্রজন্ম পর মুঘল দরবারে আরেকটি কাহিনি জন্ম নিল শাহজাহান ও মমতাজ মহলের প্রেমকাহিনি। রাজপুতানার রাজপ্রাসাদের মতো রাজনৈতিক হিসাব নয়, এই কাহিনি ছিল গভীর আবেগে ভরা। তরুণ যুবরাজ খুররম, যিনি পরে শাহজাহান নামে সম্রাট হন, এক রাজকুমারীর চোখে চোখ রেখে প্রেমে পড়েছিলেন। সেই রাজকুমারী ছিলেন মমতাজ মহল। দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে তিনি ছিলেন শাহজাহানের নিকটতম সঙ্গী। একের পর এক সন্তানের জন্ম, রাজদরবারের নানা দ্বন্দ্ব—সব কিছুর মাঝেও মমতাজ ছিলেন সম্রাটের আশ্রয়।
কিন্তু ১৬৩১ সালের গ্রীষ্মে ভাগ্য বদলে দিল ইতিহাস। মমতাজ মহল সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেলেন। সম্রাটের চোখে তখন কেবল শোক, কেবল শূন্যতা। শাহজাহান দিনের পর দিন কক্ষে একা বসে থাকতেন, শাসনের প্রতি তার মনোযোগ কমে যাচ্ছিল। প্রজারা বলত, “রাজা যেন নিজের আত্মাকে হারিয়েছেন।” সেই ব্যথা থেকেই জন্ম নিল এক চিরন্তন স্থাপত্য—তাজমহল। সাদা পাথরের এই সমাধি শুধু মমতাজের স্মৃতি নয়, শাহজাহানের হৃদয়ের রক্তক্ষরণের প্রতীক।
তবুও রাজনীতির নিয়ম নির্মম। মুঘল সাম্রাজ্য প্রেমে টিকে থাকার জন্য নয়, ক্ষমতার ভারসাম্যে দাঁড়িয়ে থাকার জন্যই জন্মেছিল। শাহজাহানের বিলাসিতা ও প্রেমে নিমগ্নতা সাম্রাজ্যের অর্থনীতিতে চাপ ফেলল। আর এই সুযোগেই তার ছেলে ঔরঙ্গজেব ক্ষমতা দখল করে তাকে বন্দি করল আগ্রার লালকেল্লায়। শেষ জীবনে শাহজাহান জানালার ফাঁক দিয়ে শুধু তাকিয়ে থাকতেন দূরের তাজমহলের দিকে, যেখানে শুয়ে আছেন তার প্রিয় মমতাজ।
আকবর যেখানে বিবাহকে ব্যবহার করেছিলেন সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ভিত্তি মজবুত করতে, শাহজাহান সেখানে প্রেমকে রূপ দিয়েছিলেন অমর স্থাপত্যে। ইতিহাস তাই এ দুই সম্রাটের কাহিনিকে রেখেছে দুই ভিন্ন রঙে—একজন নীতির স্থপতি, অন্যজন প্রেমের স্থপতি। মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসকে তাই আজও মানুষ মনে করে না শুধু তরবারির ইতিহাস, বরং হৃদয়ের ইতিহাসও।