Home ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধুলোমাখা পথে যাঁর সাংবাদিকতা হয়ে উঠেছিল মানুষের কণ্ঠস্বর

ধুলোমাখা পথে যাঁর সাংবাদিকতা হয়ে উঠেছিল মানুষের কণ্ঠস্বর

যে সাংবাদিক নিজেই ছিলেন খবর: উত্তরের চারণ মোনাজাত উদ্দিন

নয়ন দাস, কুড়িগ্রাম: বাংলাদেশের সাংবাদিকতা যখন ধীরে ধীরে শহুরে পরিসরে আবদ্ধ হয়ে পড়ছিল, যখন খবর সংগ্রহ মানে হয়ে উঠেছিল টেলিপ্রিন্টারে আসা  বার্তা আর সংবাদ সম্মেলনের রিপোর্ট, তখন উত্তরবাংলার মাটিতে হেঁটে হেঁটে, মানুষের ঘরে ঢুকে, রান্নাঘরের চুলোছুঁই করে সাংবাদিকতা করতেন একজন মানুষ। তিনি মোনাজাত উদ্দিন। ইতিহাস তাঁকে মনে রেখেছে ‘চারণ সাংবাদিক’ হিসেবে। তিনি ছিলেন এমন এক সাংবাদিক, যিনি খবরের পেছনে ছুটতে ছুটতে নিজেই হয়ে উঠেছিলেন একটি চলমান সংবাদ।

মোনাজাত উদ্দিন জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালের ১৮ জানুয়ারি, রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুর গ্রামে। কৈশোর থেকেই সাহিত্য ও সাংবাদিকতার প্রতি তাঁর ছিল গভীর অনুরাগ। ছাত্রজীবনে সাংবাদিকতা শুরু করেন বগুড়ার সাপ্তাহিক ‘বুলেটিন’ পত্রিকায়। এরপর কাজ করেছেন দৈনিক আজাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক সংবাদ ও পরে জনকণ্ঠে। তবে তাঁর পরিচয় কোনো নির্দিষ্ট পত্রিকার গণ্ডিতে আটকে ছিল না।

তাঁর সাংবাদিকতা ছিল একেবারে মাঠভিত্তিক, প্রাণস্পর্শী ও মানবিক। তাঁর রিপোর্টিং ছিল তথ্যনির্ভরতার পাশাপাশি সংবেদনশীলতার অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত সংবাদ লুকিয়ে থাকে সাধারণ মানুষের জীবনে। তাই তিনি সংবাদ খুঁজতেন নদীভাঙা চরে, বাল্যবিবাহের শিকার কিশোরীর চোখে, মঙ্গাপীড়িত রান্নাঘরের শূন্য হাঁড়িতে।

তাঁর বহুল প্রশংসিত ধারাবাহিক প্রতিবেদন ‘পথ থেকে পথে’ কিংবা ‘কানসোনার মুখ’ ছিল উত্তরাঞ্চলের গরিব মানুষের বাস্তবতার জীবন্ত দলিল। তিনি যেসব বিষয়কে সংবাদে রূপ দিয়েছিলেন, তার অনেকগুলোই জাতীয় পর্যায়ে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। সরকার পর্যন্ত নড়েচড়ে বসে। তাঁর একটি প্রতিবেদন পড়ে সরকারি সাহায্যে রাস্তা হয়, খাদ্য পৌঁছায় ক্ষুধার্ত পরিবারে। এমনই ছিল তাঁর লেখার ক্ষমতা।

তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে ‘সংবাদের নেপথ্য’, ‘পথ থেকে পথে’, ‘পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ’, ‘কানসোনার মুখ’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি নাটক, ছড়া ও কবিতায়ও পারদর্শী ছিলেন। বাংলাদেশ বেতার রংপুর কেন্দ্রের জন্যও লিখেছেন নিয়মিত।

সাংবাদিকতায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন জহুর হোসেন চৌধুরী স্মৃতিপদক, ফিলিপস পুরস্কার, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে।

তাঁর জীবন শেষ হয় এক হৃদয়বিদারক ঘটনায়। ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর, সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে গাইবান্ধার ফুলছড়িতে যমুনা নদী পার হওয়ার সময় ফেরি থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি প্রয়াণের মধ্য দিয়েও যেন বুঝিয়ে গেলেন, একজন সত্যিকারের সাংবাদিকের মৃত্যু হতে পারে খবর খুঁজতে গিয়ে।

মোনাজাত উদ্দিন ছিলেন এবং থাকবেন এক অনন্য অনুপ্রেরণা। এই দ্রুতগামী যুগে তাঁর মতো মননশীল, মাটির ঘ্রাণমাখা সাংবাদিকতা আমাদের আরও মানবিক করে তোলে।


সাংবাদিকতার এই মানবিক ধারার অনুপ্রেরণাদায়ক মানুষ সম্পর্কে আরও জানুন businesstoday24.com-এ।