Home চট্টগ্রাম মোবাইল হাতে রেললাইনে হাঁটা: তিন বন্ধুর প্রাণ গেল একসঙ্গে

মোবাইল হাতে রেললাইনে হাঁটা: তিন বন্ধুর প্রাণ গেল একসঙ্গে

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, মিরসরাই ( চট্টগ্রাম): মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের মধ্যম সোনাপাহাড় যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। বাতাস ভারী, কান্নায় কাঁপছে তিনটি ঘর। মাত্র ১৮ বছর বয়সে একসঙ্গে চিরবিদায় নিয়েছেন তিন বন্ধু—আরাফাত, আনিস ও রিয়াজ। বৃহস্পতিবার (২০ জুন) রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঢাকামুখী সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনের ধাক্কায় নিহত হন তারা।

তিনজনই এক গ্রামের, এক বয়সের, এবং বন্ধু হিসেবে অবিচ্ছেদ্য। আর শেষযাত্রাটাও হলো একসঙ্গে। দুর্ঘটনার সময় তারা চট্টগ্রামমুখী রেলপথ ধরে বিএসআরএম কারখানার দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন।

সেদিনের বিভীষিকাময় মুহূর্তের বর্ণনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া সঙ্গী রায়হান বলেন, “আমরা চারজন মিলে হাঁটছিলাম। কেউ মোবাইলে কথা বলছিল, কেউ গেম খেলছিল। পেছন দিক থেকে হুইসেল শুনে ভেবেছিলাম পাশের লেনে ট্রেন যাচ্ছে। হঠাৎ দেখি ট্রেন সামনে! আমি লাফ দিয়ে বাঁচলেও, আমার তিন বন্ধু আর বাঁচেনি।”

নিহতদের মধ্যে আনিস ছিলেন সদ্য বিবাহিত। মাত্র ২০ দিন আগে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন। তার স্ত্রী ঘরের এক কোণে নিথর পড়ে আছেন, স্বজনদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে ঘরের বাতাস। আনিসের বাবা আবু তাহের চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, “বউটা বিধবা হলো কেবল বিশ দিনে। আমি কী করে এই বোঝা বইবো?”

আরাফাত ছিলেন নানির স্নেহের একমাত্র ভরসা। শৈশবে মাকে হারানোর পর থেকে বিবি আমেনাই তাঁকে বড় করেছেন। এখন শুধু আর্তনাদ করে বারবার বলছেন, “আমার সোনার ছানারে কোথায় নিলা আল্লাহ?”

রিয়াজ ছিলেন বাবা জিয়াউর রহমানের একমাত্র ছেলে। সংসারে তিনি কিছুটা সচ্ছলতা এনেছিলেন। বাবার কণ্ঠে এখন শুধু একটি শব্দ—“আমার শান্ত ছেলেটারে কেন নিয়ে গেলা আল্লাহ?”

স্থানীয়রা বলছেন, রেললাইন হয়ে উঠেছে চলাচলের পথ। কেউ নিয়ম জানে না, কেউ সতর্ক নয়।

চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার ওসি এস এম শহিদুল ইসলাম বলেন, “তারা অমনোযোগী হয়ে রেললাইন ধরে হেঁটছিলেন। পেছন থেকে ট্রেন ধেয়ে আসে। ঘটনা ছিল দুর্ঘটনার চেয়েও বেশি অজ্ঞতা ও অসতর্কতার ফল।”

চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার আবু জাফর জানান, ভারী বৃষ্টিতে খৈইয়াছড়া ঝরনার নিচের একটি কালভার্ট দুর্বল হয়ে পড়ায় রেল চলাচলে সাময়িক লেন পরিবর্তন করা হয়েছিল। কিন্তু মানুষ এখন মোবাইল হাতে রেললাইন ধরে হাঁটছে, আড্ডা দিচ্ছে—এটা ভয়াবহ বিপদের ডেকে আনা ছাড়া কিছু নয়।

রেল কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবার—সবাই একমত: সতর্ক না হলে এমন দুর্ঘটনা বারবার ঘটবে।

মিরসরাই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স জানায়, হাসপাতালে আনার আগেই তাদের মৃত্যু হয়। লাশ নেওয়ার আগেই শতাধিক মানুষ ভিড় জমায় হাসপাতাল প্রাঙ্গণে।

রাত গভীর হলেও আলো জ্বলছিল তিনটি কবরের পাশে। শুক্রবার ভোররাতে পারিবারিক কবরস্থানে কবর দেওয়া হয় তাদের।

তিন তরুণের মৃত্যু আমাদের শুধু শোকের ভেতর ফেলে দেয় না, বরং সতর্ক করে দেয়—রেলপথ কোনো হাঁটার জায়গা নয়। একটি ভুল সিদ্ধান্ত, একটি মোবাইল ফোনের অসচেতন ব্যবহার অথবা একটি নিয়ম না জানা জীবন থেকে চিরবিদায় জানিয়ে দিতে পারে।