Home ইতিহাস ও ঐতিহ্য ওকি গাড়িয়াল ভাই… হাঁকাও গাড়ি তোমার চিলমারীর বন্দরে…

ওকি গাড়িয়াল ভাই… হাঁকাও গাড়ি তোমার চিলমারীর বন্দরে…

উত্তরবঙ্গের চাকা থেমে গেছে, গান থামেনি

নয়ন দাস, কুড়িগ্রাম: ভাওয়াইয়ার দরদভরা এই সুর কানে এলেই চোখে ভেসে ওঠে ধুলোমাখা পথ, দুটি মোষের দৃঢ় পদচারণা, আর গাড়ির চূড়ায় বসে থাকা এক উদাসী গাড়িয়ালের ছায়া। এটি শুধুই একটি লোকগান নয়, বরং উত্তরাঞ্চলের জীবন, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির এক ইতিহাস—যার কেন্দ্রে ছিল মোষের গাড়ি।
উত্তরাঞ্চলের প্রাণচাঞ্চল্য ছিল এই চাকার শব্দে

রংপুর, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম থেকে শুরু করে পুরো উত্তরবঙ্গে একসময় মোষের গাড়ির ছিল দাপট। কাঁচা রাস্তায় এই যানই ছিল পণ্য ও মানুষের যাতায়াতের প্রধান বাহন। ধান, পাট, তামাক—সবই মোষের গাড়িতে চাপিয়ে পৌঁছে যেত হাটবাজারে। এমনকি বিয়ের মালামাল, দূরপাল্লার ভ্রমণেও এই গাড়ি ছিল একমাত্র ভরসা।

গাড়িয়ালরা ছিলেন এই জীবন্ত ঐতিহ্যের রক্ষক। চাঁদের আলোয় বা কুয়াশার রাতে তাদের যাত্রা ছিল কাব্যিক অথচ কষ্টসাধ্য। তাদের ত্যাগ, একাকিত্ব আর প্রকৃতির সঙ্গে গভীর মিতালিই যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে আব্বাস উদ্দিনের ভাওয়াইয়া গানে।

চিলমারী বন্দরের দিকে হাঁটা

গানে উল্লেখ পাওয়া “চিলমারীর বন্দর” শুধু রূপক নয়, ছিল বাস্তব ইতিহাস। ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে এই নদীবন্দর একসময় ছিল উত্তরের বৃহৎ বাণিজ্য কেন্দ্র। পণ্য নিয়ে আসতেন বিভিন্ন এলাকার গাড়িয়ালরা। সেখান থেকে বড় নৌকায় যেত পণ্য ভাওয়াল অঞ্চল হয়ে কলকাতা পর্যন্ত। এই বন্দরের ধারে জমা ছিল গাড়িয়ালদের স্মৃতি, বিরহ, হাসি আর দরদ।

যখন সময় থামিয়ে দেয় চাকা

কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে সেই ধুলোপথ, সেই গরিমা। জায়গা নিয়েছে পিচঢালা রাস্তা, ট্রাক, পাওয়ার টিলার, নছিমন-করিমন ও অটোরিকশা। যেখানে একসময় দুই-তিন দিন লাগত কৃষিপণ্য হাটে পৌঁছাতে, এখন তা সম্ভব মাত্র কয়েক ঘণ্টায়। ফলে, সময় ও শ্রম বাঁচাতে মানুষ চলে গেছে আধুনিক প্রযুক্তির দিকে।

মোষের গাড়ির প্রয়োজনও ফুরিয়েছে। আয় কম, পরিশ্রম বেশি—এই পেশায় এখন আর কেউ আসতে চায় না। পূর্বপুরুষের গর্বের পেশা আজ নিতান্তই স্মৃতি। কোথাও কোথাও হয়তো আজও কৃষিকাজে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু তা ঐতিহ্য নয়, কেবল প্রয়োজন।

সুরের পথেই টিকে থাকা ঐতিহ্য

মোষের গাড়ি এখন বাস্তবের দৃশ্য নয়—এটি রয়ে গেছে কেবল ভাওয়াইয়ার সুরে, আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠে। “ওকি গাড়িয়াল ভাই” গানটি এখন আর কোনও গাড়িয়ালকে যাত্রার আহ্বান জানায় না, বরং আমাদের মনে জাগিয়ে তোলে এক বিস্মৃত ঐতিহ্যের জন্য নস্টালজিয়া।

গাড়ি আর চিলমারীর বন্দরে পৌঁছায় না, তবে সুরের রাস্তায় সেই গাড়িয়াল ভাই আজও আমাদের মনে ঘুরে বেড়ান—এক সাদামাটা কিন্তু কর্মঠ বাংলাদেশের প্রতীক হয়ে।

এমনই আরও ঐতিহ্যভিত্তিক গল্প ও সংস্কৃতির খোঁজে চোখ রাখুন businesstoday24.com–এ।