Home আন্তর্জাতিক স্বামীর বর্বরতা, যৌন নির্যাতনে মৃত্যু: নীরব পাকিস্তান

স্বামীর বর্বরতা, যৌন নির্যাতনে মৃত্যু: নীরব পাকিস্তান

বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক: “শেষবার শুধু এক চুমুক পানি চেয়েছিল,” স্মৃতিচারণ করেন সমাজকর্মী নাজমা মাহেশ্বরী। যাকে নিয়ে বলছিলেন, সে শান্তি মাত্র ১৯ বছরের এক নববধূ, যিনি বিয়ের মাত্র তিন দিনের মাথায় স্বামীর যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

লিয়ারির ঝুপড়িবসতি থেকে আসা সমাজকর্মী নাজমা শান্তির ভাই সায়নের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন করাচির সরকারি শহীদ বেনজির ভুট্টো ট্রমা সেন্টারে। তার বিবরণ হৃদয়বিদারক—“তার পায়ুপথ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল, রক্তে ভেসে যাচ্ছিল শরীর। আশপাশের রোগীরা গন্ধ সহ্য করতে না পেরে আমাদের স্ট্রেচার সরিয়ে নিতে বলেন। চিকিৎসাকালীন ওর পেট থেকে কৃমি বের করেছিল ডাক্তাররা।”

সান্ত্বনার চিহ্নমাত্র ছিল না সেই সময়টায়। হাসপাতালের বাইরে রাস্তায় বসে ছিলেন নাজমা, শান্তির বোন সোনিয়া এবং ভাই সায়ন। তখনও কেউ ভাবেনি, এই লড়াইটা শান্তি হারবে।

বর্বরতা ও মৃত্যুর ছায়া

শান্তির ভাইয়ের দায়েরকৃত মামলায় অভিযোগ করা হয়, তার স্বামী আশোক মোহন বিয়ের দু’দিন পর একটি ধাতব পাইপ, তারপর নিজের হাত এবং বাহু জোর করে পায়ুপথে ঢোকায়। এ ছাড়া শান্তির স্তনে ও গলায় কামড় দিয়ে হুমকি দেয়, যেন কিছু না বলে।

তিন দিনের মাথায় শান্তির রক্তক্ষরণ শুরু হয়। শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে দু’টি হাসপাতালে নিয়ে গেলেও শেষমেশ বাড়িতে এনে ফেলে রাখে। তখন দাবি করা হয়, ‘ওর পিরিয়ড চলছে’। শান্তির বোন সোনিয়া বলেন, “আমরা বুঝতেই পারিনি, ও মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে ছিল।”

নাজমা (মাঝখানে), সোনিয়া (নাজমার বাঁ পাশে হলুদ পোশাকে) এবং তাদের ভাই (নাজমার ডান পাশে) ট্রমা সেন্টারের বাইরে ফুটপাতে বসেছিলেন, যেখানে শান্তি জীবনের জন্য লড়াই করছিল।

দুই সপ্তাহ পর যখন ভাই সায়ন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান, তখনও শান্তি বেঁচে ছিল—কিন্তু অচেতন অবস্থায়। করাচির প্রধান পুলিশ সার্জন ডা. সুমাইয়া সায়েদ বলেন, “তার আঘাত ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। চিকিৎসার সময় বারবার মলত্যাগের ফলে তার অবস্থার আরও অবনতি হয়।”

আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ?

আইনজীবী সায়েদা বুশরা বলছেন, এটি একটি নির্ভেজাল ‘ম্যারিটাল রেপ’—বিয়ের ভিতর সংঘটিত ধর্ষণ। যদিও পাকিস্তানে এখনও সরাসরি ম্যারিটাল রেপকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি, তবে ২০১৩ সালের ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট’ এবং ২০০৬ সালের সংশোধনী অনুযায়ী স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনা সম্ভব।

কিন্তু বাস্তবতা ভয়াবহ—বিয়ের ভিতর যৌন নির্যাতনের অভিযোগ প্রায় আসে না। নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা ফওজিয়া ইয়াজদানি বলেন, “ধর্মীয় ব্যাখ্যার অপব্যবহার করে অনেক সময় এই ধরনের সহিংসতাকে বৈধতা দেওয়া হয়।”

পাকিস্তান ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে অনুযায়ী, ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৪৩ শতাংশ মানুষ স্ত্রীর উপর সহিংসতাকে যৌক্তিক বলে মনে করেন। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানে বিবাহিত নারীদের ৮৫ শতাংশই কোনো না কোনো ধরনের যৌন বা শারীরিক নির্যাতনের শিকার—যেখানে বাংলাদেশে এই হার ৫৩ শতাংশ এবং ভারতে ২৯ শতাংশ।

প্রতিবাদহীনতা ও মৌন সম্মতি

সমাজের এই মৌনতা আরও বিপজ্জনক। সিনিয়র গাইনোকলজিস্ট ডা. আজরা আহসান বলেন, “অনেক শিক্ষিত নারীও মনে করেন, স্বামীর সঙ্গে সহবাসে রাজি না হওয়াটা পাপ।” তিনি এবং তার সহকর্মীরা যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক একটি অনলাইন কোর্স চালু করেছেন—‘বাখাবর নওজওয়ান’ নামে, যেখানে এবার ‘ম্যারিটাল রেপ’ নিয়ে একটি অধ্যায় যুক্ত করা হচ্ছে।

এদিকে করাচির মেডিকো-লিগ্যাল সেন্টারে প্রতিদিন গড়ে চার থেকে আটটি যৌন সহিংসতার মামলা আসে, কিন্তু ২০২৪ সালে মাত্র তিনটি ম্যারিটাল রেপের মামলা রেকর্ড হয়েছে।

আইনজীবী বাহজাদ আকবর বলেন, “শান্তির মামলা একটি পরীক্ষামূলক বিচার হবে। এর মাধ্যমে হয়তো সমাজের নারীরা আশার আলো দেখতে পাবে।”

সমাজ কবে জাগবে?

দুঃখজনকভাবে, শান্তির মৃত্যু কোনো সামাজিক আলোড়ন তোলে না। কারণ, “সে একজন নারী ছিল”—এই একটি বাক্যেই যেন সব লজ্জার সারাংশ লুকিয়ে আছে।