বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি রপ্তানিমুখী শিল্প খাত বর্তমানে একাধিক জটিল সংকটের মুখে পড়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈশ্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতি, জ্বালানি সংকট, উচ্চ সুদের হার, এবং বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে পোশাকসহ অন্যান্য রপ্তানিখাত। ২০২৪ সালের আগস্টে গণ-আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে দেশের শতাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়ে পড়েছেন অন্তত ৬০ হাজার শ্রমিক। অর্থনীতিবিদ ও খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, এই ধারা দীর্ঘস্থায়ী হলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।
গ্যাস সংকটে অচল উৎপাদন:
বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গ্যাস সরবরাহে ঘাটতির কারণে অনেক কারখানার উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ অবস্থায় সরকার এলএনজি আমদানি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেও তার ওপর অতিনির্ভরশীলতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। ঢাকাসহ দেশের প্রধান তিনটি শিল্প এলাকায়—গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ–নরসিংদী ও সাভার–ধামরাইতে শতাধিক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে কারখানা মালিকদের পাশাপাশি বিপদে পড়েছে শ্রমিক শ্রেণিও।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “যথাযথ নীতিগত সহায়তার অভাব, উচ্চ সুদের হার, গ্যাস সংকট, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতায় আমরা ভয়াবহ চাপে পড়েছি।”
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের প্রতিবন্ধকতা:
যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসনের পুনর্ব্যবহৃত শুল্কনীতি বাংলাদেশের রপ্তানি আয়কে হুমকির মুখে ফেলেছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যে ১০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ হয়েছে, যা ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। ৯ জুলাইয়ের পর এই নীতির স্থগিতাদেশ শেষ হলে পোশাক খাত আরও বিপদে পড়তে পারে।
অন্যদিকে, ভারতের পক্ষ থেকে চলতি বছরের ১৭ মে সীমান্তবর্তী স্থলবন্দরগুলোতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ কিছু পণ্যের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় রপ্তানিকারকদের জন্য সমুদ্রপথ ব্যবহার বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে। এতে ব্যয় ও সময় দুই-ই বেড়েছে।
যুদ্ধ ও বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা:
চলমান ইরান–ইসরাইল যুদ্ধ পরিস্থিতি তেলের দামে আগুন ধরিয়েছে। এতে পরিবহন ব্যয় ও উৎপাদন খরচ বেড়েছে। বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, “এমনিতেই আমরা উচ্চ মজুরি, দুর্বল অবকাঠামো ও মুদ্রাস্ফীতির কারণে চাপে আছি। এর মধ্যে এই যুদ্ধ নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।”
বিনিয়োগ হ্রাস ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা:
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৩ দশমিক ৩ শতাংশে নামতে পারে, যা গত দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। বিদেশি বিনিয়োগও আগের তুলনায় ৭০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমে যাওয়ায় নতুন কারখানা স্থাপনও বন্ধ হয়ে পড়েছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক আশরাফ আহমেদ বলেন, “জ্বালানি সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, মালিকদের হাতে পুঁজি নেই, ফলে শ্রমিকদের বেতন দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় অর্থনীতি এক ধরনের অরাজকতার দিকে এগোচ্ছে।”
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি:
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান মনে করেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তার মতে, “নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তে কোনো বিদেশি কোম্পানি নীতিগত নিশ্চয়তা ছাড়া চুক্তিতে যাবে না। তাই সরকারের উচিত নির্দিষ্ট রোডম্যাপ দিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানো।”
বিডার দাবি: বিনিয়োগে আশার ইঙ্গিত:
তবে কিছু ইতিবাচক বার্তাও রয়েছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় প্রায় একই রয়েছে। যা অস্থির সময় পার করে কিছুটা স্থিতিশীলতার আশাও জাগায়।
সবমিলিয়ে, দেশের রপ্তানিনির্ভর শিল্প খাত এখন বহুমুখী সংকটে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্তর্জাতিক শুল্কনীতি, গ্যাস ও জ্বালানি ঘাটতি, যুদ্ধের প্রভাব—সব মিলিয়ে শিল্পে ধস নামার শঙ্কা প্রকট হয়ে উঠেছে। এখন প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক সমাধান ও স্থিতিশীল পরিবেশ—নইলে অর্থনীতি সামনে বড় সংকটে পড়তে যাচ্ছে।