বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম: বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে চট্টগ্রাম বরাবরই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ভৌগোলিক অবস্থান, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং রাজনৈতিক সচেতনতার কারণে এই অঞ্চলটি প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করে। শুধুমাত্র একটি নির্বাচনী এলাকা হিসেবে নয়, সামগ্রিকভাবে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি জাতীয় ফলাফলে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।
চট্টগ্রাম বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবেশদ্বার। এর কৌশলগত অবস্থান এটিকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির সিংহভাগ এই বন্দর দিয়েই সম্পন্ন হয়। ফলে চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক করিডোর এবং বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পগুলো জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। যে দল চট্টগ্রামে ভালো করে, তারা দেশের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে এক ধাপ এগিয়ে থাকে।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও রাজনৈতিক সচেতনতা:
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত চট্টগ্রামের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের আত্মত্যাগ – এসব ঘটনা চট্টগ্রামের মানুষকে স্বাধীনচেতা ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তুলেছে। এখানকার মানুষ দ্রুত রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এবং তাদের ভোট অত্যন্ত সচেতনভাবে প্রয়োগ করে। এই অঞ্চলের ভোটাররা সাধারণত আবেগের চেয়ে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি এবং প্রার্থীর অতীত কর্মকাণ্ডকে বেশি গুরুত্ব দেন।
অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র:
চট্টগ্রাম শুধু বন্দরের জন্য নয়, এটি শিল্পায়ন, বিনিয়োগ এবং পর্যটনেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। গার্মেন্টস শিল্প, ইস্পাত শিল্প, জাহাজ নির্মাণ শিল্প, গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান এবং প্রক্রিয়াকরণ, এবং পর্যটন খাত এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখে। দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প গ্রুপগুলোর অনেকগুলোর সদর দফতর বা প্রধান কার্যক্রম চট্টগ্রামে অবস্থিত। ফলে, সরকারের নীতি নির্ধারণ এবং ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে চট্টগ্রামের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এখানে যে দল সমর্থন হারায়, তারা দেশের অর্থনৈতিক মূল চালিকাশক্তিগুলোর সমর্থন হারাতে পারে।
আঞ্চলিক বৈচিত্র্য ও নৃতাত্ত্বিক প্রভাব:
চট্টগ্রামের নির্বাচনী মানচিত্রে বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। এখানে শহুরে, গ্রামীণ এবং পাহাড়ী অঞ্চলের মিশ্রণ রয়েছে। উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশও এখানে বসবাস করে। ফলে, প্রতিটি সংসদীয় আসনে প্রার্থীর জনপ্রিয়তা, আঞ্চলিক ইস্যু এবং স্থানীয় সংস্কৃতির প্রভাব দেখা যায়। এই বৈচিত্র্যময় ভোটারদের মন জয় করা একটি চ্যালেঞ্জ, কিন্তু যে দল এটি সফলভাবে করতে পারে, তারা জাতীয় পর্যায়েও ব্যাপক সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়।
পর্যটন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা:
কক্সবাজার, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির মতো জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রগুলো চট্টগ্রামের কাছাকাছি হওয়ায় এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অনেক। দেশের অন্যতম ব্যস্ত বিমানবন্দর শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও চট্টগ্রামে অবস্থিত। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং পর্যটন শিল্পের বিকাশ দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সরাসরি প্রভাব ফেলে, যা ভোটারদের সিদ্ধান্ত গ্রহণেও প্রভাব ফেলে।
জাতীয় রাজনীতির ব্যারোমিটার:
অনেক বিশ্লেষক চট্টগ্রামকে জাতীয় রাজনীতির ব্যারোমিটার হিসেবে বিবেচনা করেন। এখানকার নির্বাচনের ফলাফল প্রায়শই জাতীয় ফলাফলের একটি পূর্বাভাস দেয়। যে দল চট্টগ্রামে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, জাতীয় পর্যায়ে তাদের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। কারণ, চট্টগ্রামের ভোটাররা সাধারণত জাতীয় ট্রেন্ডের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ভোট দেন।
সুতরাং, শুধু আসনের সংখ্যা বিবেচনায় নয়, কৌশলগত, অর্থনৈতিক এবং ঐতিহাসিক কারণেও চট্টগ্রাম বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিটি দলই এই অঞ্চলের ভোটারদের মন জয় করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে, কারণ তারা জানে, চট্টগ্রামের জয় মানেই জাতীয় পর্যায়ে বিজয়ের এক বড় ধাপ।










