মোজাফফর রাহমান বাদল, কুষ্টিয়া: বাংলার রেল ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করে রানাঘাট-জগতি রেলপথ, যা এ অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে নির্মিত এই রেললাইন শুধুমাত্র যাত্রী পরিবহন নয়, পণ্য পরিবহন এবং প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ বিস্তারে বিশেষ অবদান রেখেছিল।
ইতিহাসের পাতায় প্রথম যাত্রা
১৮৬২ সালের নভেম্বর মাসে খুলনা ও যশোর অঞ্চলের সঙ্গে কলকাতার সংযোগ স্থাপন লক্ষ্যে রানাঘাট থেকে জগতি পর্যন্ত রেললাইন চালু হয়। এই রেলপথের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৭৪ কিলোমিটার। রানাঘাট, যা বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে অবস্থিত, এবং জগতি, যা এখন বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার অংশ—এই দুই স্থানের মধ্যকার এই রেললাইন ছিল পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) প্রথম রেল সংযোগ।
নির্মাণ ও লক্ষ্য
ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি এই প্রকল্পের দায়িত্ব নেয়। তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল কলকাতা বন্দরের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের কৃষিপ্রধান অঞ্চলগুলোর সংযোগ স্থাপন করা, যাতে ধান, পাট ও অন্যান্য পণ্য সহজে রপ্তানি করা যায়। রানাঘাট হয়ে এই রেলপথ চুঁচুড়া, গেদে হয়ে বাংলাদেশের দর্শনা ও কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
দর্শনা হয়ে নতুন দিগন্ত
রেলপথটি যখন দর্শনা হয়ে জগতিতে প্রবেশ করে, তখন সেটি ছিল পূর্ব বাংলার ইতিহাসে প্রথম রেল চলাচল। জগতি স্টেশন নির্মিত হয় অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এবং তা কিছুদিনের মধ্যেই হয়ে ওঠে ব্যবসায়িক এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। পর্যায়ক্রমে এই রেলপথ কুষ্টিয়া, পাবনা, রাজশাহী এবং উত্তরবঙ্গের সঙ্গে সংযুক্ত হয়।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য
রানাঘাট-জগতি রেলপথ কেবল পরিবহনের সুযোগ বাড়ায়নি, এটি সেই সময়কার প্রশাসনিক তৎপরতা ও সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অন্যতম বাহন হয়ে ওঠে। তবে একইসঙ্গে এই রেলপথ কৃষকদের পণ্য বাজারজাতকরণ এবং শহরের সঙ্গে গ্রামের যোগাযোগ বাড়িয়ে অর্থনৈতিক সম্ভাবনারও দুয়ার খুলে দেয়।
স্বাধীনতার পর পরিবর্তন
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর রানাঘাট ও জগতির মধ্যকার রেলপথের আন্তর্জাতিক সীমা নির্ধারিত হয়। রানাঘাট রয়ে যায় ভারতের অংশে, আর জগতি পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। এরপর এই রুটে আন্তর্জাতিক চলাচল সীমিত হয়ে পড়ে, যদিও দর্শনা সীমান্ত দিয়ে এখনো কিছু ট্রেন চলাচল করে।
জগতির ঐতিহাসিক গুরুত্ব
জগতি রেলস্টেশন একসময় ছিল ভীষণ ব্যস্ত। ব্রিটিশ আমলে এই স্টেশন হয়ে কলকাতাগামী এবং খুলনা-যশোরগামী অনেক ট্রেন চলত। এখান থেকে কুষ্টিয়া শহর, শিলাইদহ, কুমারখালীসহ আশপাশের এলাকায় যোগাযোগ সহজ হয়। আজও স্থানীয়রা এই স্টেশনকে ইতিহাসের একটি জীবন্ত স্মারক হিসেবে বিবেচনা করেন।
রানাঘাট-জগতি রেলপথ শুধু একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা নয়, এটি ছিল বাংলা অঞ্চলের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক বিকাশের এক অমূল্য সাক্ষ্য। এই রেলপথের মাধ্যমে যে আধুনিক যোগাযোগের সূচনা হয়েছিল, তা আজও আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়।