পর্ব ১:
রামগড়: পাহাড়ের প্রান্তে এক সম্ভাবনাময় জনপদ’
বাংলাদেশের মানচিত্রে এক কোণায় সুনসানভাবে দাঁড়িয়ে আছে রামগড়। খাগড়াছড়ি জেলার দক্ষিণ প্রান্তে ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তঘেঁষা এক জনপদ। ইতিহাসে রামগড় কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এক ঘাঁটি; ভবিষ্যতের স্বপ্নেও জায়গা করে নিয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথের সম্ভাবনায়।
রামগড় শুধু একটি উপজেলা নয়, এটি একটি জীবনপদ্ধতির প্রতিচ্ছবি। এখানে জুমচাষে দিন ফুরায়, বিকেলে বাজারে পাহাড়ি কাপড় বিক্রি হয়, সন্ধ্যায় সীমান্তের আলো আর বিজিবি-বিএসএফের টহল সরে যায় ছোট গ্রামগুলোর পাশ দিয়ে। প্রকৃতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি আর অর্থনীতির টানাপোড়েনে গড়া রামগড়।
এই সিরিজে আমরা রামগড়কে দেখব তার বহুমাত্রিক বাস্তবতায়—ইতিহাস, সীমান্ত, স্থলবন্দর, পাহাড়ি জনগোষ্ঠী, প্রাকৃতিক পরিবেশ, শিক্ষা-স্বাস্থ্য সংকট, প্রশাসনিক সহযোগিতা ও সবচেয়ে বড় কথা—এলাকার মানুষদের চোখ দিয়ে। তাদের জীবন, তাদের ভাষা, তাদের প্রত্যাশাই হবে আমাদের প্রতিবেদনগুলোর কেন্দ্রে।
একটি জনপদের গল্প শুধু মানচিত্রে লেখা থাকে না, লেখা থাকে মানুষের মুখে, মাঠে, নদীতে, অভাবের হাসিতে, প্রতিবাদের কণ্ঠে। সেই রামগড়কে তুলে আনতে আমরা শুরু করছি আমাদের দশ পর্বের অনুসন্ধানী ধারাবাহিক—
‘ রামগড়: পাহাড়ের প্রান্তে এক সম্ভাবনাময় জনপদ’
মো. মাসুদ রানা, রামগড় ( খাগড়াছড়ি): বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে, খাগড়াছড়ি জেলার দক্ষিণে অবস্থিত একটি ছোট্ট উপজেলা রামগড়। এখানকার প্রকৃতি পাহাড়ি, অথচ সমতলের ছোঁয়াও আছে। সীমান্তবর্তী এই জনপদের একদিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, অন্যদিকে বাংলাদেশের ফেনী জেলা। পাহাড় আর সীমান্ত ঘেরা এই জনপদের পরিচয় যেন বহুমাত্রিক ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার এক অনবদ্য মিশেল।
রামগড় উপজেলা গঠিত হয় ১৯৮৩ সালে, কিন্তু তার ইতিহাস অনেক পুরনো। এখানকার ভূপ্রকৃতি ও জনজীবন প্রাচীনকাল থেকেই ভিন্নধর্মী। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী চাকমা, ত্রিপুরা, মারমা বং সমতলের বাঙালি বসতি মিলে রামগড়ে তৈরি হয়েছে এক বিচিত্র সামাজিক বিন্যাস। ফেনী নদী রামগড়কে বিভক্ত করে রেখেছে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড ও ত্রিপুরার সঙ্গে, আর সেই নদীর বুকেই এখন গড়ে উঠছে এক আন্তর্জাতিক স্থলবন্দর।
রামগড়ের জনসংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। এখানকার অধিকাংশ মানুষ কৃষিজীবী। পাহাড়ি জমিতে আনারস, আদা, হলুদ আর জুম চাষ হয় বছরের বড় একটি সময়জুড়ে। অন্যদিকে সমতলের মানুষ ধান চাষ আর হাটবাজারভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, এত সম্ভাবনার পরও রামগড়ের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ দুর্বল। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে ঘাটতি, সড়ক যোগাযোগের সমস্যা, এবং সীমান্তবর্তী ঝুঁকি—সব মিলিয়ে রামগড় এক ধরনের উন্নয়ন বঞ্চনার চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রামগড়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য তার সীমান্ত ঘেঁষা চরিত্র। এখান থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুম শহর মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে। দুই দেশের মধ্যে একসময় ছিল মানুষের যাতায়াত, পারস্পরিক বাজার, আত্মীয়তার সম্পর্ক। এখন সীমান্তের কাঁটাতার সবকিছু আলাদা করে দিয়েছে। তবুও এখান থেকে স্থলবন্দর গড়ে ওঠার সম্ভাবনা অনেক দূর এগিয়েছে। ২০১৭ সালে রামগড়-সাবরুম স্থলবন্দরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এটি পুরোপুরি কার্যকর হলে দুই দেশের মধ্যে একটি নতুন বাণিজ্যিক দ্বার খুলে যাবে।
রামগড় শুধু সীমান্ত নয়, এটি এক ধরনের সংস্কৃতি ও সম্প্রীতির কেন্দ্র। এখানকার পাহাড়ি-বাঙালি সহাবস্থান অনেকটা অনন্য। যদিও অতীতে কিছু সহিংস ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু বর্তমানে সামাজিক সম্পর্ক স্বাভাবিক এবং শান্তিপূর্ণ। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ‘গরিয়া পূজা’ হোক বা বাঙালি মুসলমানদের ঈদ, কিংবা মারমাদের ‘ওয়াগেইন উৎসব’—সবই রামগড়ে মিলেমিশে উদ্যাপিত হয়।
তবে রামগড়ের সবচেয়ে বড় অভাব হলো অবকাঠামো ও সেবাব্যবস্থার উন্নয়ন। বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, পানীয়জল এবং শিক্ষার অভাবে মানুষ প্রতিনিয়ত কষ্ট করছে। সীমান্তবর্তী এলাকার বিশেষ চাহিদা থাকলেও জাতীয় নীতিমালায় সেগুলো বারবার উপেক্ষিত। ফলে রামগড়ের মানুষ প্রতীক্ষায় থাকে—কখন উন্নয়নের ছোঁয়া তাদের পাহাড়ি জনপদে এসে পৌঁছাবে।
- এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমরা রামগড়ের না বলা গল্পগুলো তুলে ধরতে চাই। আগামী পর্বে আমরা ফিরে যাব ইতিহাসে—ব্রিটিশ আমলে রামগড়ের গার্ড পোস্ট, চা বাগান, এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এ জনপদের কৌশলগত গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করব।
“রামগড়কে জানুন, বাংলাদেশকে নতুনভাবে চিনুন”