Home সারাদেশ সীমান্তে জীবন: টহল, প্রতীক্ষা আর আত্মীয়তার টান

সীমান্তে জীবন: টহল, প্রতীক্ষা আর আত্মীয়তার টান

রামগড় পর্যটন লেক। ছবি সংগৃহীত

পাহাড়ের প্রান্তে এক সম্ভাবনাময় জনপদ’- পর্ব: ৩

মো. মাসুদ রানা, রামগড় ( খাগড়াছড়ি): রামগড় উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বাংলাদেশের সীমান্ত ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে মিশে গেছে। কোথাও কাঁটাতার, কোথাও পাহাড়ের ঢালু, আবার কোথাও ফেনী নদী—এইসব মিলে রামগড় এক অনন্য সীমান্ত জনপদ। তবে এখানকার সীমান্ত শুধু মানচিত্রে নয়—এটি মানুষের জীবন, কাজকর্ম, স্বপ্ন ও ভবিষ্যতের সঙ্গে গেঁথে আছে প্রতিদিন।

সীমান্ত এলাকায় জীবনযাত্রা একরকম কঠোর বাস্তবতায় গাঁথা। বিজিবি (বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড) এবং ভারতের বিএসএফ-এর কড়া নজরদারি, প্রতিদিনের টহল, নদীপাড়ে সতর্কতামূলক মাইকিং, নির্দিষ্ট সময় ছাড়া চলাচল বন্ধ—সব মিলিয়ে এক প্রকার অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণে বাস করেন এখানকার মানুষ। অনেক পরিবারের আত্মীয়-স্বজন ওপারে, কেউ কেউ আবার ‘সীমান্ত ভুলে’ ওপারে গিয়ে আটকে পড়েছেন দিনের পর দিন। দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক কিংবা সাময়িক উত্তেজনা সরাসরি প্রভাব ফেলে এই নিরীহ সীমান্তবাসীর জীবনে।

রামগড়ের সীমান্তঘেঁষা গ্রামগুলোতে এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা ভোরে নিজেদের ক্ষেতের পাশে কাজ করতে গিয়ে বিএসএফের জেরায় পড়েছেন। কোনো জমি সীমান্ত রেখার এত কাছে যে সেখানে কাজ করাও ‘সন্দেহজনক কার্যকলাপ’ বলে বিবেচিত হয়। আবার অন্যদিকে, সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে সন্ধ্যার পর স্বাভাবিক চলাচলও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে—কারণ তখন বেড়ে যায় নিরাপত্তা সতর্কতা।

তবে সব সমস্যা সত্ত্বেও এখানকার মানুষগুলো কখনো হার মানেনি। সীমান্তকে শুধু বাধা নয়, তারা সম্ভাবনার দুয়ার হিসেবেও দেখে। বিশেষ করে রামগড়-সাবরুম স্থলবন্দর চালুর সম্ভাবনা এখানকার জনজীবনে নতুন আশার আলো জাগিয়েছে। বর্তমানে বন্দর আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হলেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কার্যক্রম শুরু হয়নি। পণ্য পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, কাস্টমস সুবিধা, নিরাপদ সড়ক ও গুদাম ব্যবস্থাপনার অভাবে এ বন্দর এখনও একটি ‘প্রতীক্ষার প্ল্যাটফর্ম’ হয়েই আছে।

সীমান্তের আরেকটি বড় সংকট হলো অবৈধ চলাচল ও চোরাচালান। যদিও বিজিবির তৎপরতা বেড়েছে, তবুও সীমান্তের ভেতরে-বাইরে পণ্য পাচার, কাঠ বা গরু আনার অভিযোগ পাওয়া যায়। এতে যেমন আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন ওঠে, তেমনি স্থানীয় জনপদে একটি ভয় ও সন্দেহের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতি তরুণ সমাজের জন্যও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়—তাদের শিক্ষা ও কর্মজীবনের পথ অনেক সময় বাধাগ্রস্ত হয়।

তবে সীমান্ত শুধু আতঙ্ক নয়—এটি এক মানবিক যোগাযোগের জায়গাও বটে। বিয়ের সূত্রে, পারিবারিক ইতিহাসে, সামাজিক বিনিময়ে—বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী মানুষদের মধ্যে এক গভীর, অদৃশ্য যোগসূত্র রয়েছে। অনেকে আজও বলেন, “সীমান্ত মানে বাঁধা নয়, বরং ভাগাভাগির কষ্ট।”

রামগড়ের সীমান্ত তাই এক বহুমাত্রিক বাস্তবতা। একদিকে নিরাপত্তা, নিষেধাজ্ঞা ও রাজনৈতিক কৌশল—অন্যদিকে মানুষের বেঁচে থাকা, চলাফেরা, স্বপ্ন দেখা এবং সম্ভাবনার পিছু ধাওয়া। এই সীমান্তে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ দূর থেকে ভারতের আলো ঝলমলে গ্রাম দেখতে পান, আবার কেউ ভোরবেলায় নদীর ওপারে থাকা আত্মীয়ের বাড়ি খুঁজে ফেরেন। এই দ্বৈততায় গড়ে উঠেছে রামগড়বাসীর সাহসী, সংগ্রামী এক জীবনচিত্র।