বিষের ছায়ায় কৃষি ও জনস্বাস্থ্য: পর্ব-৪
তারিক-উল-ইসলাম, ঢাকা: বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আরেকটি অবহেলিত সংকট হলো পানির দূষণ। ফসল উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক কীটনাশক ও সার মাঠে ছিটানোর পর সেখানেই থাকে না, বরং ধুয়ে গিয়ে আশপাশের পানি উৎসে মিশে যায়। খাল-বিল, নদী কিংবা নলকূপ, সব জায়গাতেই এই দূষণের অদৃশ্য স্রোত পৌঁছে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, যা দীর্ঘমেয়াদে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য বড় হুমকি তৈরি করছে।
বর্ষার সময় সমস্যাটি আরও প্রকট হয়। প্রবল বর্ষণে জমির উপরিভাগের মাটি ও রাসায়নিক দ্রব্য রাস্তার পাশে থাকা নালা বা খালে নেমে যায়। পানি প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো দুই থেকে তিন কিলোমিটার দূরের জলাশয় পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে। স্থানীয় মানুষ খাল বা পুকুরের পানি দিয়ে রান্না, গোসল বা গবাদিপশু পরিচর্যা করেন, ফলে এসব বিষাক্ত রাসায়নিক পরোক্ষভাবে মানবদেহে প্রবেশ করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের অনেক অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানিতেও কীটনাশকের অস্তিত্ব মিলেছে। নিয়মিত ব্যবহার ও আবহমান সময়ের জমাট মিশ্রণের ফলে বিষাক্ত উপাদান ধীরে ধীরে মাটির স্তর ভেদ করে নলকূপের পানিতে পৌঁছে যায়। যদিও চোখে দেখা যায় না, তবুও এই রাসায়নিক উপাদান পরিমাণে সামান্য হলেও দীর্ঘমেয়াদে বিপজ্জনক। বিশেষ করে এমন এলাকায় যেখানে ফসলের মৌসুমে ঘন ঘন স্প্রে করা হয়, সেখানে পানি দূষণের মাত্রা তুলনামূলক বেশি।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কীটনাশকের অনেক উপাদান পানিতে দ্রবণীয়। এগুলো জলজ ecosystem-এ প্রবেশ করলে সেখানে থাকা মাছ, ব্যাঙ, জলজ উদ্ভিদ এমনকি ক্ষুদ্র প্ল্যাঙ্কটন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিয়মিত এই দূষণের কারণে অনেক জলাশয়ে মাছের প্রজনন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, যা স্থানীয় মৎস্যচাষীদের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
খাল-বিলের এই দূষণ কৃষকের অজান্তেই ঘটে। অনেক কৃষক মনে করেন, পানিতে ধুয়ে যাওয়ায় রাসায়নিক ক্ষতি কমে যাবে। কিন্তু বাস্তবে একটি বড় অংশ সরাসরি পানি উৎসে মিশে তার গুণগত মান নষ্ট করে দেয়। এতে শুধু পানির জৈবিক ভারসাম্য নষ্ট হয় না, মানুষের জন্যও তৈরি হয় নীরব বিপদ। শিশুরা যে পুকুরে সাঁতার কাটে, গৃহস্থরা যে পানি ব্যবহার করেন—সবকিছুর মধ্যেই বাসা বাঁধে এই বিষাক্ত উপাদান।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে পানি-জনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ত্বকের সমস্যা, পেটের ব্যাধি, অ্যালার্জি কিংবা দীর্ঘমেয়াদি কিডনি জটিলতা—অনেক ক্ষেত্রেই এর পেছনে দূষিত পানির ভূমিকা রয়েছে বলে জানিয়েছে চিকিৎসকেরা। তবে সুনির্দিষ্ট রাসায়নিক শনাক্ত করা ও সঠিক কারণ নির্ধারণে পর্যাপ্ত পরীক্ষাগার সুবিধা না থাকায় সমস্যার পূর্ণ চিত্র সামনে আসে না।
পরিবেশবিদদের মতে, এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য জরুরি ভিত্তিতে পানি পরীক্ষার পরিধি বাড়ানো, কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ও নিষিদ্ধ রাসায়নিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি কৃষিজমির পাশে buffer zone বা সবুজ বেষ্টনী তৈরি করলে রাসায়নিক সরাসরি পানিতে ধুয়ে যাওয়ার প্রবণতা অনেক কমে আসতে পারে।
বাংলাদেশের পানি সম্পদ ইতোমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তন ও ভূগর্ভস্থ পানির আহরণে চাপে রয়েছে। তার ওপর যদি যোগ হয় কৃষিজ রাসায়নিক দূষণের ছায়া, তবে পানির নিরাপত্তা ভবিষ্যতে আরও সংকটাপন্ন হবে।
পরবর্তী পর্বে থাকছে
শিশুর দেহে নীরব বিষ: গর্ভবতী মা, শিশু ও কিশোরদের ওপর প্রভাব
লাইক দিন 👍, শেয়ার করুন 🔁, এবং মন্তব্যে জানান আপনার মতামত!










