আনোয়ার আহমেদ, কুয়ালালামপুর ( মালয়েশিয়া ): দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশ মালয়েশিয়ায় কয়েক দশক ধরে গড়ে উঠেছে এক বিশাল বাংলাদেশি প্রবাসী সমাজ। তাদের অনেকেই এখন আর শুধু নির্মাণ শ্রমিক নন কারও হাতে রেস্টুরেন্ট, কেউ মালিক ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির, কেউবা গ্রোসারি দোকানের উদ্যোক্তা। কিন্তু এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে একাধিক পরিশ্রমে ভরা অধ্যায়।
বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয় মূলত ১৯৮৬ সালের দিকে। তখন কৃষি ও নির্মাণ খাতেই সীমাবদ্ধ ছিল নিয়োগ। নব্বইয়ের দশকে পরিস্থিতি বদলায়, বাড়ে শ্রমিক নিয়োগের পরিমাণ ও খাতের পরিধি। বর্তমানে সরকারি হিসাবে প্রায় পাঁচ লাখ বৈধ বাংলাদেশি এখানে কর্মরত থাকলেও, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রবাসীদের বড় অংশ কাজ করেন নির্মাণ প্রকল্প, রাবার ও পাম চাষ, ইলেকট্রনিক্স কারখানা, পরিষেবা ও হোটেল-রেস্টুরেন্ট খাতে। একজন নির্মাণ শ্রমিকের মাসিক আয় গড়ে ১২০০ থেকে ২০০০ রিংগিত, অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। অতিরিক্ত ওভারটাইম করলে আয় বাড়ে কিছুটা। তবে খরচও কম নয়—বিশেষ করে যারা বৈধ কাগজপত্র ছাড়া রয়েছেন, তারা থাকেন দিনরাত আতঙ্কে।
তিন প্রবাসীর অভিজ্ঞতা
গাজীপুরের সাত্তার মিয়া মালয়েশিয়ায় এসেছেন ২০১৬ সালে। এখন সেলাঙ্গরে একটি নির্মাণ সাইটে কাজ করেন। তার ভাষায়, “প্রতিদিন দশ-বারো ঘণ্টা কাজ করি। রোদ-বৃষ্টি মানি না। মাসে যা পাই, তার পুরোটাই দেশে পাঠাই। কিন্তু এই টাকায় আমার জীবন চলে না। পরিবারটাই বড়।”
বরিশালের শাহীনুর রহমান মালয়েশিয়ায় এসেছেন ২০০৪ সালে। একসময় কারখানার শ্রমিক ছিলেন, এখন কুয়ালালামপুরে একটি মিনি-মার্ট চালান।
“প্রথমে ভিসা সমস্যায় পড়েছিলাম। পরে ব্যবসার লাইসেন্স নিয়ে ফেলি। এখন স্ত্রী-সন্তান নিয়েই থাকি। দোকান ভালো চলে, মাসে আট-দশ হাজার রিংগিত আয় হয়। তবে টিকে থাকতে হলে সততা আর ধৈর্য জরুরি।”
কুমিল্লার মেহেদী হাসান মাত্র ২১ বছর বয়সে পেনাংয়ে আসেন। এখন স্থানীয় এক বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে কাজ করেন। “বাইরে থেকে অনেকে ভাবে খুব ভালো জীবন। কিন্তু দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করার পর রাতেও ডেলিভারিতে যেতে হয়। পরিবার ছাড়া ঈদটাও কেমন যেন ফাঁকা লাগে।”
শ্রমিক থেকে উদ্যোক্তা
বর্তমানে কুয়ালালামপুর, পেনাং, শাহ আলম, জহোর বারু ও সেলাঙ্গর অঞ্চলে শত শত বাংলাদেশি মালিকানাধীন দোকান, রেস্টুরেন্ট, ট্রাভেল এজেন্সি ও মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টার রয়েছে। অনেকে আবার নির্মাণ ঠিকাদারি, পরিবহন ও আমদানি-রপ্তানির সঙ্গেও যুক্ত হয়েছেন। এসব ব্যবসায় লাভজনক আয় নিশ্চিত করতে পারলে মাসিক আয় লক্ষাধিক রিংগিতও হতে পারে বলে জানা গেছে।
প্রতারণা আর ভয়ের বাস্তবতা
তবে সাফল্যের এই ছবির পেছনে রয়েছে বহু আঁধার অধ্যায়। অনেকেই দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুইয়ে পাসপোর্টহীন অবস্থায় কাজ করেন দিনমজুরের মতো। মালিকরা অনেক সময় বেতন আটকে রাখেন, আবার পুলিশের তল্লাশিতে বৈধ কাগজ না থাকলে আটক হয়ে ডিপোর্ট হতে হয়।
বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে একাধিকবার শ্রমচুক্তি স্বাক্ষর হলেও বাস্তব পরিস্থিতিতে সেই নিরাপত্তা সবসময় নিশ্চিত হয় না।
তবু আশার কথা—এইসব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি নিজেদের পরিশ্রমে গড়ে তুলছেন সম্মানজনক অবস্থান। পাঠানো রেমিট্যান্সে বদলে যাচ্ছে গ্রামের চিত্র, বাড়ছে শিক্ষার হার, গড়ে উঠছে নতুন ঘর।
📌 আপনার পরিচিত কেউ মালয়েশিয়ায় আছেন?
এই প্রতিবেদনটি তাদের সঙ্গে শেয়ার করুন, যেন তারাও নিজের গল্প বলার সুযোগ পান।
💬 আপনি কি প্রবাসী? অথবা প্রবাসে কাউকে চেনেন?
আপনার অভিজ্ঞতা বা মতামত কমেন্টে লিখে জানাতে পারেন। আমরা বাছাইকৃত মন্তব্য প্রতিবেদনের পরবর্তী পর্বে প্রকাশ করব।
🔁 শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন প্রবাসীদের জীবনের না বলা গল্পগুলো।
প্রবাস জীবনের সুখ-দুঃখ সবাই জানুক, সবাই বুঝুক।