সংগৃহীত ছবি
বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম : একসময় বিশ্বজুড়ে জাপানি রিকন্ডিশন্ড গাড়ির ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। নির্ভরযোগ্যতা, জ্বালানি দক্ষতা এবং তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে শুরু করে উন্নত বিশ্বের একটি অংশের বাজারেও এর চাহিদা ছিল আকাশচুম্বী। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, নতুন গাড়ির উৎপাদন বৃদ্ধি, কঠোর আমদানি নীতি এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে এই বাজারে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। জাপানি রিকন্ডিশন্ড গাড়ির চাহিদা কি কমেছে নাকি বেড়েছে? গত এক বছরে এর দামের কী পরিবর্তন হয়েছে? জাপান থেকে রপ্তানির পরিসংখ্যানই বা কী বলছে? এই প্রতিবেদনে সেই চিত্র তুলে ধরা হলো।

বৈশ্বিক চাহিদার বর্তমান চিত্র: মিশ্র প্রবণতা: জাপানি রিকন্ডিশন্ড গাড়ির চাহিদা এখন আর একক প্রবণতায় নেই, বরং দেশভেদে এর ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে।

কিছু দেশে চাহিদা কমেছে: উন্নত দেশগুলোতে নতুন গাড়ির সহজলভ্যতা বৃদ্ধি, ইভি (ইলেকট্রিক ভেহিকেল) এবং হাইব্রিড গাড়ির প্রতি ক্রমবর্ধমান ঝোঁক, এবং পুরোনো গাড়ির উপর পরিবেশগত কঠোর বিধিনিষেধের কারণে জাপানি রিকন্ডিশন্ড গাড়ির চাহিদা কমেছে। বিশেষত ইউরোপের কিছু দেশ এবং উত্তর আমেরিকায় এই প্রবণতা স্পষ্ট।

কিছু উন্নয়নশীল দেশে স্থিতিশীল বা সামান্য বৃদ্ধি: আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া (যেমন বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা), এবং কিছু ক্যারিবীয় অঞ্চলে এখনো জাপানি রিকন্ডিশন্ড গাড়ির একটি বিশাল বাজার বিদ্যমান। এই দেশগুলোতে নতুন গাড়ির উচ্চ মূল্য এবং সীমিত আয়ের কারণে সাধারণ মানুষের কাছে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির আকর্ষণ অক্ষুণ্ন আছে। তবে কিছু দেশ কঠোর আমদানি নীতি গ্রহণ করায় সামগ্রিক চাহিদা প্রভাবিত হচ্ছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব: রাশিয়া, যা জাপানি রিকন্ডিশন্ড গাড়ির একটি বড় বাজার ছিল, এখন নিষেধাজ্ঞার কারণে অনেক ব্র্যান্ডের নতুন গাড়ি আমদানি করতে পারছে না। ফলে পুরোনো গাড়ির প্রতি তাদের চাহিদা বেড়েছে, এবং এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন রুট দিয়ে জাপানি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি রাশিয়ায় প্রবেশ করছে, যা জাপানের রপ্তানি পরিসংখ্যানকে প্রভাবিত করছে।

গত এক বছরে দামের পরিবর্তন: উর্ধ্বমুখী প্রবণতা: গত এক বছরে জাপানি রিকন্ডিশন্ড গাড়ির দাম সামগ্রিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে:

বৈশ্বিক চিপ সংকট: কোভিড-১৯ মহামারীর পর থেকে শুরু হওয়া বৈশ্বিক চিপ সংকট নতুন গাড়ির উৎপাদনে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। এর ফলে নতুন গাড়ির সরবরাহ কমেছে এবং অপেক্ষার সময় বেড়েছে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে পুরোনো গাড়ির বাজারে। নতুন গাড়ির দাম বাড়ায় এবং সহজলভ্যতা কমায় মানুষ পুরোনো গাড়ির দিকে ঝুঁকছে, যা রিকন্ডিশন্ড গাড়ির দাম বাড়াতে সাহায্য করেছে।

জাপানি ইয়েনের অবমূল্যায়ন: ডলার এবং অন্যান্য প্রধান মুদ্রার বিপরীতে জাপানি ইয়েনের দুর্বলতা জাপানি গাড়ি আমদানিকারকদের জন্য এক ধরনের সুবিধা তৈরি করেছে। আমদানিকারকদের কম ইয়েন পরিশোধ করতে হওয়ায়, আপাতদৃষ্টিতে এটি দাম কম মনে হলেও, জাপানের ভেতরের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং শিপিং খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায়, চূড়ান্ত ব্যবহারকারীর জন্য দাম বেড়েছে।

শিপিং খরচ বৃদ্ধি: বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন সমস্যা এবং জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে জাহাজীকরণের খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, যা শেষ পর্যন্ত গাড়ির চূড়ান্ত মূল্যে যুক্ত হচ্ছে।

উচ্চ মান ও নির্ভরযোগ্যতা: জাপানি গাড়ির দীর্ঘস্থায়িত্ব এবং কম রক্ষণাবেক্ষণ খরচ এখনো ক্রেতাদের কাছে এটিকে একটি পছন্দের বিকল্প হিসেবে টিকিয়ে রেখেছে, যা দাম বাড়ার পরও চাহিদা ধরে রাখতে সাহায্য করছে।

জাপান থেকে রপ্তানির পরিসংখ্যান: একটি বিশ্লেষণ

জাপান অটোমোবাইল ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (JADA) এবং জাপান অটোমোবাইল ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (JAIA) এর তথ্য অনুযায়ী, জাপানি রিকন্ডিশন্ড গাড়ির রপ্তানি প্রবাহে অস্থিরতা দেখা গেছে।

মোট রপ্তানি মূল্য বৃদ্ধি, ইউনিট সংখ্যায় ভিন্নতা: অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, রপ্তানিকৃত গাড়ির ইউনিট সংখ্যা কিছুটা কমলেও, মোট রপ্তানি মূল্য বেড়েছে। এর কারণ হলো, প্রতি ইউনিটের গড় মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ, দাম বাড়ার কারণে জাপানি রপ্তানিকারকরা কম গাড়ি বিক্রি করেও বেশি আয় করছেন।

মহাদেশীয় রপ্তানি ধারা:

আফ্রিকা: এখনো জাপানি রিকন্ডিশন্ড গাড়ির অন্যতম প্রধান গন্তব্য। কেনিয়া, তানজানিয়া, উগান্ডার মতো দেশগুলো উচ্চ হারে আমদানি অব্যাহত রেখেছে, যদিও স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন কিছু প্রভাব ফেলছে।

ওশেনিয়া (নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া): এই দেশগুলোতে তুলনামূলকভাবে নতুন মডেলের রিকন্ডিশন্ড গাড়ির চাহিদা বেশি, এবং ইভি ও হাইব্রিড মডেলের প্রতিও আগ্রহ বাড়ছে।

দক্ষিণ এশিয়া: বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার মতো দেশে আমদানি শুল্ক এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করায় কিছু সময় রপ্তানি কমেছিল, তবে চাহিদা এখনো শক্তিশালী।

রাশিয়া: নিষেধাজ্ঞার কারণে সরাসরি রপ্তানি কমে গেলেও, মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোর মাধ্যমে রাশিয়ায় জাপানি গাড়ির প্রবাহ বেড়েছে।

শীর্ষ রপ্তানিকৃত মডেল: টয়োটা অ্যাকোয়া, প্রিউস, ফিট, ভিটজ, করোলা এবং বিভিন্ন এসইউভি মডেলের চাহিদা এখনো বেশি।

ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস:

আগামী দিনগুলোতে জাপানি রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বাজার আরও প্রতিযোগিতামূলক হবে। নতুন গাড়ির উৎপাদন স্বাভাবিক হলে এবং ইভি প্রযুক্তির দ্রুত প্রসারের ফলে পুরোনো পেট্রোল-ডিজেল গাড়ির প্রতি চাহিদা কিছুটা কমতে পারে। তবে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্রয়ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা এবং জাপানি গাড়ির ব্র্যান্ড ইমেজ এখনো এই বাজারের একটি বড় অংশ ধরে রাখতে সহায়ক হবে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সাপ্লাই চেইন স্বাভাবিকীকরণ হলে এই বাজারে নতুন ভারসাম্য আসতে পারে।