Home অন্যান্য নির্জনতার রূপকথা

নির্জনতার রূপকথা

ছোট গল্প

রেহান কৌশিক

 

হঠাৎ চোখ পড়ল চিলেকোঠায়। এত দূর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু মনে হল কেউ নড়াচড়া করছে! অবাক হল শ্রুতি।

রাস্তার ওপারে বাড়িটা জরাজীর্ণ। ঠিক প্রাগৈতিহাসিক কোনও অতিকায় জন্তুর কঙ্কাল। দেওয়ালের নানা জায়গায় জংলা গাছ শিকড় ছড়িয়েছে। অধিকাংশ জানলায় পাল্লা নেই। ধাতব শিকগুলো রোদে-জলে কবেই উধাও!

পরিত্যক্ত বাড়িটায় কি কেউ এল? বাংলোর দোতলা থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। শ্রুতি বইয়ের র‌্যাক থেকে বাইনোকুলারটা নামাল।

বাইনোকুলারে চোখ রাখতেই ভাঙাবাড়ির চিলেকোঠা স্পষ্ট হল। একটা টেবিল-ল্যাম্প জ্বলছে। হলদে আলো ছড়িয়ে আছে টেবিলে এবং সেখানে একটা লোক টেবিলের ওপর ঝুঁকে কী যেন করছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না। জানলার দিকে পিঠ। পিঠ অল্প ওঠানামা করছে। তাতেই বোঝা যাচ্ছে লোকটা কিছু একটা করছে।

মহুলডুংরি জায়গাটা নিরিবিলি। ময়ূরঝুঁটি পাহাড়ের কোলে বিন্দি নদী। নদীর পর ঢেউখেলানো পাথুরে ভূমি। এদিক-ওদিক, যতদূর চোখ যায় ছোটখাটো ডুংরি। তাদেরই আশপাশে শিমুল, পলাশ, শাল, মহুলের গাছ। সংখ্যায় খুব কম।

জায়গাটার নাম কেন মহুলডুংরি, কে জানে! হয়তো এককালে অজস্র মহুলগাছ ছিল। পুরো জায়গাটাকেই গ্রেভইয়ার্ড বলে মনে হয়। ডুংরিগুলো যেন এক-একজন সাহেবের কবর। বিদেশে এসে আর নিজের দেশে ফিরতে পারেনি। মারা গেছে। সেই কতকাল আগে থেকে কবরগুলো উঁচুনীচু পাথুরে মাটির ওপর নিঃশব্দে জেগে আছে। রাস্তা দিয়ে স্কুটি চালিয়ে কলেজ যাওয়া-আসার ফাঁকে এমনই উদ্ভট ভাবনা মাথায় ঘোরে শ্রুতির।

শ্রুতিদের বাংলো বিন্দি নদীর তীরে। অদূরে কয়লাখনি। শ্রুতির বাবা সুরঞ্জন মুখোপাধ্যায় খনির ইঞ্জিনিয়ার। সেই সূত্রে এই বাংলো। আশপাশে আরও কয়েকটি বাংলো আছে। খনির অন্য অফিসারদের। শ্রুতিদের বাংলো একদম দক্ষিণে। দোতলার বারান্দায় দাঁড়ালে পাহাড় ডিঙোনো হাওয়া বিন্দি নদীর জল ছুঁয়ে উঠে এসে ঝাপটা দেয়। নীচে যে রাস্তাটা চলে গেছে শহরের দিকে, কালো পিচের মসৃণ এই রাস্তা ধরেই স্কুটি চালিয়ে কলেজ যায় শ্রুতি।

দু’বছর হল এখানে এসেছে। কোনওদিন বাড়িটায় কাউকে দেখেনি। তাই এত বিস্ময়। শ্রুতি বাইনোকুলারে আবার চোখ রাখল। লোকটা উঠে দাঁড়িয়েছে। ছ’ফুটের কাছাকাছি লম্বা। টিকোলো নাক। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। মাঝবয়সি। ছিপছিপে।  সুদর্শন।

বাইনোকুলার নামিয়ে রাখল। কারও প্রাইভেসিতে নাক গলানো অনুচিত—মনে হল শ্রুতির। জানলা বন্ধ করে দিল।

কিছুক্ষণের মধ্যে লোকটার কথা বেমালুম ভুলে গেল। ভালো করে স্নান করল। কলেজ থেকে ফিরে স্নান করলে আরাম লাগে। মাথায় টাওয়াল জড়িয়ে টোস্ট ও কফি বানাল। মাইন থেকে বাবার ফিরতে ইউজুয়ালি বেশ রাত হয়।

শ্রুতি যখন আট, মা মারা গেছে। বরাবরই একা থাকতে হয়েছে। ফলে এই নির্জন বাংলো, বিন্দির পাশে জেগে থাকা নিঃশব্দ পাহাড়, পাহাড়ি উপত্যকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ডুংরিগুলোর নিশ্চল শুয়ে থাকা, শাল, মহুয়া, শিমুলের শব্দহীন দাঁড়ানোর ভিতর সে নিজের নিঃসঙ্গতাকে আলাদা করতে পারে না। বরং এই একাকিত্ব, এই নির্জনতা ভালোই লাগে। তবে ইদানীং একটা কথা বারবার মনে হয়। কথাটা ফ্রেঞ্চ রাইটার বালজাকের। সলিটিউড ইজ ফাইন বাট ইউ নিড সামওয়ান টু টেল সলিটিউড ইজ ফাইন।

সামওয়ান! সামওয়ান! এই সামওয়ান কে? এই সামওয়ান কোথায়? টোস্ট শেষ করে কফি মগ নিয়ে বিছানায় কাত হয়। টুং টুং মেসেজ নোটিফিকেশন আসে। মোবাইলের স্ক্রিন সোয়াইপ করে। হোয়াটসঅ্যাপে একটা ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়েছে লিটন। লিটন একটা পাথরের ওপর বসে আছে। হাতে গিটার। পাথুরে মাটির ওপর দুটো কফি মগ। মগ থেকে বাষ্প উঠছে। অদূরে জড়ো করা নুড়ি-পাথরের অস্থায়ী চুলায় কাঠ জ্বলছে। আগুনের ওপর লোহার স্ট্যান্ড থেকে ঝুলছে জল গরম করার কেটলি। পাহাড়ি দিগন্তে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। লিটন গাইছে—মহব্বত বরসা দে না তু, শাওন আয়া হ্যায়…

আসলে লিটন গাইছে না। টনি কক্করের গান ব্যাকগ্রাউন্ডে ইউজ করে শুট করেছে। ক্লিপের সঙ্গে মেসেজে লিখেছে—টু মগস, ওয়ান সানসেট, নো নোটিফিকেশনস। ওয়ান মগ ইজ ফর মি। অ্যানাদার? অ্যানাদার শব্দটার পর তিনটে জিজ্ঞাসা চিহ্ন দিয়েছে।

মেসেজটা দেখে মুচকি হাসল শ্রুতি। মনে মনে বলল—বেচারা! কফিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে রিং করল সাহানাকে।

বল।

লিটন আবার মেসেজ করেছে।

নাচছে না গাইছে?

গাইছে। মহব্বত বরসা দে না তু…

ওয়ান মগ ইজ ফর মি, অ্যানাদার? এসব লিখেছে তো?

অবাক হল শ্রুতি। সাহানা জানল কী করে!

কী রে চুপ করে গেলি কেন?

না। অ্যাকচুয়ালি…

অবাক হওয়ার কিছু নেই।

শ্রুতি কেন অবাক হবে না, তা খোলসা করল না সাহানা। গুম হয়ে গেল শ্রুতি। লাস্ট দু’হপ্তা লিটন তাকে আপ্রাণ ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছে। সাহানা বলল, তোকে তো বলেছিলাম, আর যাকে পাত্তা দিস, লিটনকে নয়। খতরনাক বাটারফ্লাই… ফুল হলে ভুল করবি, ডার্লিং। লিটন মধু খেয়ে উড়ে যাবে।

সাহানার কথা শুনে গা গুলিয়ে উঠল। অস্বস্তি হচ্ছে শ্রুতির। কোনওরকমে একটা দুটো কথা বলে ফোন কেটে দিল।

দীর্ঘক্ষণ চুপ করে বিছানায় শুয়ে রইল। হঠাৎ পোড়ো বাড়িতে আসা আগন্তুকের কথা মনে পড়ল। শ্রুতি বিছানা থেকে নেমে জানলা খুলল এবং খুলে চমকে গেল।

লোকটা চিলেকোঠার ঘরে নেই। ছাদে অল্প কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যেন নিশ্চল কোনও মূর্তি। আকাশভরা জ্যোৎস্না। তাই দেখা যাচ্ছে।

আবার বাইনোকুলার হাতে নিল শ্রুতি। চোখ রাখতেই একদম স্পষ্ট হল। লোকটা টেলিস্কোপে আকাশ দেখছে।

লোকটা আকাশ দেখছে। আর সে দেখছে লোকটাকে। ভাবতেই কেমন যেন হাসি পেল শ্রুতির। সেই সঙ্গে কৌতূহল। লোকটা কে? কোথা থেকে এল? কী নাম? মেসেজ সংক্রান্ত মনের তিতকুটে ভাব উধাও হয়ে গিয়েছে।

বাংলোর নীচে বাবার গাড়ি থামল। জানলা থেকে সরে এল শ্রুতি। নীচে নামতেই সুরঞ্জন বললেন, ফিরতে দেরি হয়ে গেল।

একই কথা প্রতিদিন বলো কেন?

সুরঞ্জন হাসলেন। এ-হাসি বিষণ্ণতায় জড়ানো। শ্রুতির দিকে তাকিয়ে বললেন, অভ্যাস।

অবান্তর অভ্যাস ত্যাগ করা কি ভালো নয়?

একটু বিচলিত দেখাল সুরঞ্জনকে। বললেন, কিছু অভ্যাসের সঙ্গে সুন্দর স্মৃতি গাঁথা হয়ে থাকে। তাই কিছু অভ্যাস হয়তো অবান্তর নয়। থাক না। ক্ষতি কী?

শ্রুতির মনে পড়ল—বাইরে থেকে বাসায় ফিরলেই মায়ের সামনে ঠিক এই কথাটাই বলত। এখন লজ্জা লাগছে শ্রুতির। অনুশোচনাও।

দোতলায় উঠে এল। চোখ চলে গেল সেই ছাদের দিকে। লোকটা এখনও ছাদে। টেলিস্কোপের ভিউপয়েন্টে মুখ গোঁজা। তবে টেলিস্কোপের মুখটা ছিল পুব-দক্ষিণে। এখন একদম পুবে। তফাত বলতে এটুকুই।

পারদ ফোঁটার মতো টলমলে রুপোলি জ্যোৎস্না। আবছায়া পাহাড়, গাছপালা, নদী ও ডুংরি ছড়ানো বিজন প্রান্তরে গড়িয়ে যাচ্ছে। গড়ানো জ্যোৎস্না ঢাল বেয়ে নেমে যাচ্ছে বিন্দির বুকে। জলের রং করে তুলছে গাঢ় রুপোলি। নানা গাছপালার ফাঁকে শরীরে নীলচে আগুন নিয়ে উড়ছে অজস্র জোনাকি। এই নির্জন, এই নরম চরাচরে শ্রুতির বুকের ভিতর আশ্চর্য এক মনকেমনের কম্পন ছুঁয়ে গেল!

মনে পড়ল—ঠিক এমন কম্পন আগেও একবার টের পেয়েছিল। এই তো কয়েক মাস আগে, কলেজ ক্যান্টিনে। বাইরে মেঘলা দুপুর। ছায়াচ্ছন্ন আলোর বুকে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিদানা প্রজাপতির মতো ভাসছে। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হাতে গিটার তুলে নিয়েছিল শতদ্রু। কর্ডে রিনরিন করে বেজে উঠেছিল—তুমকো পায়া হ্যায় তো জ্যায়সে খোয়া হু / ক্যাহ্ না চাহুঁ ভি তো তুমসে ক্যায়া কহুঁ…

শাহরুখ দীপিকার র‌োমান্টিক দৃশ্যটার কথা ভেবে বন্ধুরা টেবিল চাপড়ে গলা মেলাল। শ্রুতির কিন্তু শাহরুখের কথা মনে হল না। শেষের কবিতার অমিতের কথা মনে হল। শিলংয়ের কোনও পাহাড়ি নির্জনে লাবণ্যকে কি কখনও এমন করে গান শুনিয়েছিল অমিত?

পরক্ষণেই লজ্জা হল। ধ্যাৎ। অমিত তো নিবারণ চক্রবর্তী ছদ্মনামে কবিতা লিখত। গান তো কখনও গায়নি। অমিত নয়, শাহরুখ নয়, শতদ্রু নয়, হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা দিয়ে কেউ কি তাকে গান শোনাবে? কবিতা শোনাবে? কখনও? কোনওদিন?

লাবণ্য নয়, দীপিকা নয়, সে শ্রুতি। কেউ কি আসবে? কেউ? যার কাছে সে তার নিজস্ব নির্জনতার মুহূর্তগুলো বলতে পারবে? কথার সঙ্গে কথা মিশে গড়ে উঠবে নির্জনতার এক আশ্চর্য রূপকথা?

আজ, এই মুহূর্তে কোনও একজনের জন্য বুকের ভিতর হুহু করে উঠল। বুকের গভীরে শুধু একটা কথারই প্রতিধ্বনি বারবার ফিরে আসছে—ইউ নিড সামওয়ান টু টেল সলিটিউড ইজ ফাইন!

রাত্রিতে ভালো ঘুম হল না। ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই লোকটার কথা মনে পড়ল। বাইনোকুলার নিয়ে দ্রুত জানলা খুলল। দেখল, লোকটা ছাদে বসে একমনে জুতো সেলাই করছে। সাধারণ জুতো নয়। সেনারা যেমন জুতো পরে, অবিকল সেরকম। জুতো সেলাইয়ের দৃশ্যটা চমৎকার নয়। কিন্তু তার কাজ করার একাগ্রতাটা চমৎকার। ভালো করে তাকাল। বাবা না হলেও বাবার কাছাকাছি বয়স। শান্ত মুখমণ্ডল অদ্ভুত এক মায়ায় জড়ানো। লোকটাকে দেখে মন ভালো হয়ে গেল।

মোবাইলে রিং হল। সাহানা কলিং। রিসিভ করল শ্রুতি, এত সকালে!

শোন না, ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাসের অ্যাসাইনমেন্টটা কমপ্লিট করেছিস?

কিছু করেছি। অনেকগুলো পারিনি।

পারিসনি নাকি করিসনি?

পারিনি। সংক্ষিপ্ত জবাব দিল শ্রুতি।

আজ কলেজে আনবি। কী করেছিস একটু দেখব। আমি কিছুই পারিনি।

আজ কলেজ যাব না। হঠাৎ বলল শ্রুতি।

কেন রে?

শরীর ভালো নেই। অক্লেশে মুখ দিয়ে মিথ্যে বেরিয়ে গেল।

কী হয়েছে? জ্বর।

জ্বর না। তবে শরীর ভালো না।

কথা শেষ করে শ্রুতি আবার জানলার দিকে এগোল। দেখল, লোকটা ছাদে নেই। চিলেকোঠার ঘরেও তাকে দেখা যাচ্ছে না। মন বিষণ্ণ হয়ে উঠল।

হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলকের মতো কয়েকটা কবিতার লাইন মনে এল—স্পষ্ট আমি দেখি তাকে, মধ্যরাতে ছাদে যখন টেলিস্কোপে চোখ রেখে সে দেখে আকাশটাকে। /স্পষ্ট আমি দেখি তাকে, আমার তো বেশ ভালোই লাগে, মাঝবয়সি লম্বা মানুষটাকে। / যখন দাঁড়ায় খোলা হাওয়ায় / অদৃশ্য কেউ পর্দা সরায় / আমার চোখে উড়তে থাকে বিকেল-রংয়ের খুব চেনা এক পাখি। / ইচ্ছে করে পাখির মতো মানুষটাকে বুকের ভিতর আদর করে রাখি। / নাম জানি না। বেশ তাতে কী? / মনে মনে নাম রেখেছি—পলাশকাকু। / পলাশকাকু বুঝতে পারো কেমন করে ছড়ায় আবির বসন্তের এ-দিন? / জানতে পারো পলাশকাকু, কলেজ পড়া একটি মেয়ে কোন  সাহসে চোখের পাতায় যত্নে সাজায় ঋণ? / ফিজিক্স-নোটে মেঘ নেমেছে, আলোর গতি, ভরের সূত্র বৃষ্টিতে থইথই / এমন দিনে পলাশকাকু সত্যি করে বলো আমায়—আমি তোমার বান্ধবী কি নই?

চমকে উঠল শ্রুতি। কবির নাম মনে নেই। কিন্তু যিনি লিখেছেন, এ তো হুবহু তারই কথা! কবিরা কি সব জানে? সব কথা বুঝতে পারে? মানুষের না-বলা সব কথা? কে জানে!

তিনদিন কলেজমুখো হল না শ্রুতি। কী এক অলৌকিক মায়াঘোরে গ্রস্ত সমস্ত শরীর, সকল চেতনা! নিজের ভিতর যেন অন্য এক অচেনা মানুষকে বয়ে বেড়াচ্ছে সে! সারাক্ষণ উন্মুখ হয়ে থাকে মানুষটাকে এক ঝলক দেখার জন্য। কখনও দেখা মেলে। কখনও মেলে না।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই কতবার প্রশ্ন করেছে—তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছ, শ্রুতি? তুমি কি অপ্রকৃিতস্থ? উত্তর দেয়নি প্রতিবিম্ব। বাবার রুম থেকে পুরোনো তানপুরা এনে মেঝেয় রেখেছে। তার সামনে বসে জিজ্ঞেস করল—পলাশকাকু, তুমি কি সেই সামওয়ান, যাকে আমি আমার নির্জনতার কথা অকপটে বলতে পারি?

হাসল তানপুরা। বলল, তুমি তো শুধু বলতে চাইছ না, শ্রুতি। তুমি তোমার নির্জনতা নিয়ে আশ্রয় চাইছ। নরম আশ্রয়।

তাই যদি হয়, তুমি কি আমার সেই আশ্রয়?

আবার মৃদু হাসি ফুটে উঠল তানপুরার ঠোঁটে। এই হাসি ভালো লাগল শ্রুতির। তানপুরা বলল, এই আশ্রয় পেতে হলে তোমাকে যে অস্থিরতা ত্যাগ করতে হবে, শ্রুতি।

মানে?

যুদ্ধক্ষেত্রে গোলাগুলির মাঝে সৈনিকরা যখন বাংকারে আশ্রয় চায়, তাদের তীব্র অস্থিরতা থাকে। সেই অস্থিরতার কারণ, মৃত্যুভয়। কিন্তু তুমি চাইছ ভালোবাসার আশ্রয়। হৃদয়ের আস্তানা। ভালোবাসার আশ্রয়ে অস্থিরতা নিয়ে নয়, শান্ত, স্থিতধী হয়ে প্রবেশ করতে হয়।

রাত্রিদিন তার তানপুরা, তার পলাশকাকুর সঙ্গে আশ্চর্য রূপকথার গল্প গাঁথা হতে থাকে। শ্রুতি ভাবে—এই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। সুন্দর সময়।

পঞ্চমদিনের রাত্রি সমস্ত তছনছ করে দিল। স্থানীয় পুলিশ ও স্পেশাল এসটিএফ তল্লাশি চালাচ্ছে জরাজীর্ণ বাড়িতে। কুখ্যাত এক টেররিস্ট নাকি আত্মগোপন করেছিল এখানে। নিরীহ বাড়িটায় লোকজনের কোলাহল, মিডিয়ার বুম, ক্যামেরায় ছয়লাপ।

সকালের কাগজ হাতে উঠে এলেন সুরঞ্জন। মেয়ের দিকে কাগজ এগিয়ে দিয়ে কিছু বলতে যেতেই ইশারায় বাবাকে থামিয়ে দিল শ্রুতি। কাগজে দেখল ভাঙাবাড়ির ছবি। টেররিস্ট পলাতক, সে কথাও লিখেছে। হঠাৎ কেঁদে উঠল শ্রুতি। বলল, আমার পলাশকাকু সন্ত্রাস নয়, আকাশ ভালোবাসে। আমার প্রেমিক রক্ত নয়, নির্জনতা ভালোবাসে। বাবা, এ-এক রাষ্ট্রের গভীর চক্রান্ত!

সুরঞ্জন নিজের মেয়েকে এই মুহূর্তে ঠিক চিনতে পারলেন না। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। দেখলেন, শ্রুতি নয়, অচেনা এক মেয়ে খবরের কাগজটা দুমড়েমুচড়ে দলা পাকিয়ে ছুড়ে দিল জানলার বাইরে, শূন্যে।