Home অন্যান্য হারিয়ে যাওয়া রূপকথার বাক্স: বায়োস্কোপের শেষ ঘণ্টা।

হারিয়ে যাওয়া রূপকথার বাক্স: বায়োস্কোপের শেষ ঘণ্টা।

তারিক-উল-ইসলাম: গ্রামবাংলার মেলা কিংবা ধুলোবালি মাখা মেঠোপথ। দূরে কোথাও শোনা যাচ্ছে টিনের বাক্সে ডুগডুগির ‘তাক-ডুম তাক-ডুম’ শব্দ। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হুল্লোড় করে ছুটছে। ওই তো আসছে সেই জাদুর বাক্স! কাঁধে বাঁশ আর ঝোলানো বাক্স নিয়ে হাজির বায়োস্কোপওয়ালা। আজ সেই দৃশ্য শুধুই এক ধূসর স্মৃতি। যান্ত্রিকতার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া এই লোকসংস্কৃতি আজ যেন এক দীর্ঘশ্বাসের নাম।

বায়োস্কোপ মানে কেবল একটা কাঠের বাক্স ছিল না; ওটা ছিল এক টুকরো সিনেমা হল, এক চিলতে স্বপ্ন। বাক্সের গায়ে লাগানো ছোট ছোট গোল কাঁচের ছিদ্র দিয়ে চোখ পাতলে দেখা যেত জাদুর পৃথিবী। ভেতরে ঘুরছে মক্কা-মদিনার দৃশ্য, তাজমহল, আজমির শরীফ কিংবা সিনেমার নায়ক-নায়িকার স্থিরচিত্র।

আর নেপথ্যে থাকত বায়োস্কোপওয়ালার সেই চিরায়ত সুর ও বর্ণনা: “দেখিয়া যান চমৎকার, দিল্লির ওই কুতুব মিনার/ কী চমৎকার দেখলা রে ভাই, তাজমহলের কারুকাজ…”

সেই ছন্দময় বয়ান আর হাতে ঘোরানো ছবির রেলগাড়ি শিশুদের মনে ছড়িয়ে দিত অজানাকে জানার আনন্দ। একটি ছবির পর আরেকটি ছবি আসার সেই রোমাঞ্চ আজকের স্মার্টফোনের গতির কাছে হয়তো নগণ্য, কিন্তু তার মধ্যে ছিল এক পরম আত্মিক শান্তি।

বাঙালি সাহিত্যে বায়োস্কোপ এক অমর অনুষঙ্গ। বিভূতিভূষণ থেকে শুরু করে আধুনিক কবিদের কবিতায় বায়োস্কোপ বারবার ফিরে এসেছে হারানো শৈশবের প্রতীক হিসেবে। কথাসাহিত্যে একে দেখা হয়েছে গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের সহজ বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে। অনেক লেখক বায়োস্কোপকে সময়ের রূপক হিসেবে ব্যবহার করেছেন—যেখানে জীবনের ছবিগুলো একটার পর একটা পাল্টে যায়, কিন্তু বাক্সের ওপাশের জাদুকরকে কেউ দেখতে পায় না।

সাহিত্যিক দৃষ্টিতে, বায়োস্কোপ ছিল ‘চলমান স্থিরচিত্র’। এটি আমাদের শিখিয়েছিল যে আনন্দ পাওয়ার জন্য বিশাল বড় পর্দার প্রয়োজন হয় না, বরং মনের চোখ দিয়ে দেখার আগ্রহটাই আসল।

প্রশ্ন জাগতে পারে, ডিজিটাল যুগে কি বায়োস্কোপের কোনো প্রাসঙ্গিকতা আছে? উত্তর হলো—হ্যাঁ, তবে বদলে গেছে তার রূপ।

ভার্চুয়াল রিয়ালিটি (VR): আজকের ভিআর হেডসেট মূলত বায়োস্কোপেরই এক আধুনিক ও উন্নত সংস্করণ। সেই প্রাচীন বাক্সের কনসেপ্ট থেকেই মানুষ আজ থ্রি-ডি দুনিয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে।

হেরিটেজ ট্যুরিজম: বিভিন্ন থিম পার্ক বা আর্ট গ্যালারিতে এখন কৃত্রিমভাবে বায়োস্কোপ প্রদর্শন করা হয়, যাতে নতুন প্রজন্ম তাদের শেকড়ের ঘ্রাণ পায়।

ডিজিটাল আর্কাইভিং: পুরোনো সেই বায়োস্কোপের ছবিগুলো এবং বায়োস্কোপওয়ালাদের ছন্দময় গানগুলো এখন ইউটিউব বা পডকাস্টের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এটি মূলত ঐতিহ্যের সাথে আধুনিক প্রযুক্তির এক মেলবন্ধন।

বায়োস্কোপ আজ বিলুপ্তপ্রায়। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এটি হয়তো এক অদ্ভুত আদিম খেলনা। কিন্তু বায়োস্কোপের যে সারমর্ম—মানুষকে গল্প শোনানো আর একটুখানি নির্মল বিনোদন দেওয়া—তা আজও বেঁচে আছে চলচ্চিত্রের রুপালি পর্দায় কিংবা স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে। তবুও, সেই টিনের বাক্সের ঘ্রাণ আর ডুগডুগির শব্দ কি আর ফিরে আসবে? বায়োস্কোপ হয়তো নেই, কিন্তু আমাদের নস্টালজিয়ায় সে আজও এক অমলিন জাদুর বাক্স হয়েই থাকবে।