বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: সব জল্পনার অবসান। হোয়াইট হাউসের রোজ় গার্ডেন থেকে রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফের ঘোষণা করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বাংলাদেশি পণ্যে ৩৭ শতাংশ রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ ঘোষণা করেছেন ট্রাম্প। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে সমস্ত পণ্যে রপ্তানি করা হবে, তার উপর ৩৭ শতাংশ আমদানি শুল্ক চাপাবে আমেরিকা।
ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় বুধবার বিকেল ৪টায় (বাংলাদেশ সময় বুধবার দিবাগত রাত ২টা) হোয়াইট হাউসের রোজ় গার্ডেনে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন করে শুল্ক ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
‘মেক আমেরিকা ওয়েলদি এগেন’ ইভেন্টে ট্রাম্প জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিন পণ্যে উচ্চ হারে শুল্ক চাপাচ্ছে বিভিন্ন দেশ। তাই পাল্টা শুল্ক বা রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ চাপাচ্ছেন তিনি। নিজের চাপানো ট্যারিফকে ‘কাইন্ড’ তকমাও দিয়েছেন।
বাংলাদেশ থেকে একাধিক পণ্যে মার্কিন মুলুকে যায়। সেই সমস্ত পণ্যের উপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক ধার্য হলে আমেরিকার বাজারে সেই সমস্ত জিনিসের দাম বাড়বে। এতদিন যুক্তরাষ্ট্রে আমদানিতে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক ছিল। নতুন এই শুল্ক আরোপে বাংলাদেশের রপ্তানি, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ৮৪০ কোটি ডলারের মতো পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়ে থাকে যার বেশিরভাগ তৈরি পোশাক। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছিল ৭৩৪ কোটি ডলার।
ট্রাম্পের বক্তব্য: আজ আমেরিকার লিবারেশন ডে। আজ রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফের ঘোষণা করব। ওরা আমাদের উপর দীর্ঘদিন ধরে শুল্ক চাপিয়েছে। তাই আমরা পাল্টা চাপাচ্ছি। খুব সহজ হিসাব। আমেরিকার সোনার দিন আবার ফিরতে চলেছে। আমেরিকাকে আবার সেরা বানাবো। একটু আগে গোটা বিশ্বে রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ চালুর এগজ়িকিউটিভ অর্ডার সই করেছি। বক্তব্যে ভারত, চিন, মেক্সিকো এবং ক্যানাডাকেও তীব্র আক্রমণ করেন ট্রাম্প।
আমেরিকার বাইরে তৈরি গাড়ির উপরে ২৫ শতাংশ শুল্কের ঘোষণা আগেই করেছিলেন ট্রাম্প। আজ থেকেই তা কার্যকর হবে। ট্রাম্পের এই ঘোষণার পরই হাততালির ঝড় ওঠে রোজ় গার্ডেনে।
রোজ় গার্ডেনে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমেরিকার শুল্ক ফারাক তুলে ধরছেন ট্রাম্প। রীতিমতো তালিকা ধরে তুলনা করছেন ট্রাম্প। জাপান, ভিয়েতনাম, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ক্যানাডা, চিন, মেক্সিকোর পর ভারতের নাম ট্রাম্পের।
কোন দেশের পণ্যে কত শুল্ক চাপাবে আমেরিকা, তালিকা দিলেন ট্রাম্প:
চিন- ৩৪%
ভারত- ২৬%
ইউরোপীয় ইউনিয়ন- ২০%
জাপান- ২৪%
দক্ষিণ কোরিয়া- ২৫%
সুইজ়ারল্যান্ড- ৩১%
ব্রিটেন- ১০%
মালয়েশিয়া- ২৪%
ব্রাজ়িল- ১০%
ইন্দোনেশিয়া- ৩২%
ভিয়েতনাম- ৪৬%
সিঙ্গাপুর- ১০%
দক্ষিণ আফ্রিকা- ৩০%
ইজ়রায়েল- ১৭%
পাকিস্তান- ২৯%
বাংলাদেশ- ৩৭%
শ্রীলঙ্কা- ৪৪%
বিভিন্ন মার্কিন সংস্থা আমেরিকায় বিনিয়োগ না করে অন্য দেশে বিনিয়োগ করে বলে অভিযোগ ট্রাম্পের। এ ব্যাপারে নাম নিলেন অ্যাপল-সহ একাধিক সংস্থার। এর বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রধানের উদ্দেশে ট্রাম্পের বার্তা, ‘আপনাদের ট্যারিফ তুলে নিন।’
ট্রাম্প ট্যারিফ কী?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর রকমের পণ্য যায় আমেরিকায়। সেই সব পণ্যের উপর ধার্য হয় আমদানি শুল্ক। যা ইমপোর্ট ডিউটি নামেও পরিচিত। এই শুল্কই বৃদ্ধি করলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দ্বিতীয় বার মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর যে শুল্ক তিনি চাপাচ্ছেন, তাকেই ট্রাম্প ট্যারিফ হিসাবে অভিহিত করা হচ্ছে। শুল্ক বাবদ আদায় হওয়া টাকা যাবে মার্কিন কোষাগারে। এর জেরে আমেরিকার সরকারের আয় বাড়বে।
ট্যারিফ চাপানোর নিয়ে ট্রাম্পের যুক্তি
জানুয়ারি মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পদে বসার পর থেকেই মার্কিনি পণ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উচ্চ হারে শুল্ক বসানো নিয়ে সরব হয়েছেন ট্রাম্প। এর প্রেক্ষিতেই এসেছে তাঁর রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফের ভাবনা। পাল্টা শুল্ক চাপানোর পিছনে একাধিক যুক্তি বিভিন্ন সময় নিজের বক্তব্যে তুলে ধরেছেন ট্রাম্প।
- ট্রাম্প মনে করেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মার্কিনি পণ্যে যে হারে কর চাপায় তা অনায্য। কারণ ওই সব দেশের পণ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপানো আমদানি শুল্কের হার অনেক কম। এই ফারাক ঘোচাতেই রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ বসাচ্ছেন বলে দাবি ট্রাম্পের।
- আমেরিকার ঘরোয়া উৎপাদন বা ডোমেস্টিক ম্যানুফ্যাকচারিং বাড়ানোর উদ্দেশ্যেও এই শুল্ক চাপানোর কথা সাম্প্রতিক অতীতে একাধিক বার বলে বেড়িয়েছেন ট্রাম্প। বিদেশি পণ্যে শুল্ক বসানোর জেরে সেগুলির দাম বেড়ে যাবে মার্কিন বাজারে। এর জেরে আমদানি কমিয়ে আমেরিকার অভ্যন্তরে বেশি পণ্যের উৎপাদনের চেষ্টা চলবে, এটাই ট্রাম্পের ইচ্ছা। এর মাধ্যমে ‘মাগা’র স্বপ্ন সত্যি হবে বলে মনে করেন ট্রাম্প।
- আমদানি শুল্ক বসানোর মাধ্যমে সরকারের আয় বাড়াতে চাইছেন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট। শুল্কের মাধ্যমে আয় বাড়িয়ে নাগরিকদের আয়করে ছাড়ের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনার কথাও শুনিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
- ট্রাম্পের ট্যারিফ ঘোষণার পিছনে আরও একটি উদ্দেশ্য খুঁজে পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তা হলো বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সংক্রান্ত রফা করার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা। শুল্ক চাপিয়ে আগেই চাপ তৈরি করে রাখলেন তিনি।
ট্যারিফ বাজারে কী ভাবে প্রভাব ফেলবে?
শুল্ক বৃদ্ধির অর্থ জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়া। জিনিসের দাম বাড়লেই বিভিন্ন ভাবে তা ব্যবসাকে প্রভাবিত করে।
- কোনও পণ্যের দাম বাড়লে বিক্রিতে তার প্রভাব পড়ে। তা সে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যই হোক বা বিলাসিতার উপাদান। এর জেরে বিক্রি কমার আশঙ্কা থাকে।
- করের সঙ্গে দ্রব্যের দামের মোকাবিলা করতে গিয়ে কোম্পনি অনেক সময় জিনিসের দাম বাড়ায় না। এর জেরে কোম্পানি প্রফিট প্রভাবিত হতে পারে। ব্যবসা চালানোর খরচ এর জেরে বেড়ে যেতে পারে।
- কোনও এক পণ্যের দাম বৃদ্ধি অন্য এক পণ্যের দিকে ঝুকতে বাধ্য করে গ্রাহকদের। কোম্পানিগুলি যে দেশের পণ্যে শুল্ক বেশি, তা না এনে যে দেশের পণ্যে আমদানি শুল্ক কম, সে দেশের পণ্য বেশি আমদানি করা শুরু করে। এর জেরে মার্কেট শিফ্টিংয়ের মতো ঘটনা দেখা দিতে পারে।
সব মিলিয়ে ট্রাম্পের এই ট্যারিফ ঘোষণার রেশ দীর্ঘস্থায়ী হতে পাবে বিশ্ববাণিজ্যের আঙিনায়। বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্পের এই রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ বিশ্বকে বাণিজ্য যুদ্ধের দিকেও ঠেলে দিতে পারে। এই ট্যারিফ আমেরিকার বাজারেও মন্দার পরিস্থিতি তৈরি করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন একাধিক বিশেষজ্ঞরা।